অ্যামনেস্টির বার্ষিক প্রতিবেদন সরকারের সমালোচনা ও দুর্নীতির রিপোর্ট করায় বাংলাদেশে নিপীড়নের শিকার সাংবাদিকরা

দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করার কারণে এবং সরকারের কোভিড-১৯ নীতির সমালোচনার কারণে ক্রমবর্ধমান হারে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের সাংবাদিকরা। মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বহুল বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ২০১৮। করোনা মহামারিকালে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা পর্যাপ্ত আকারে সুরক্ষিত ছিল না অথবা পূরণ করা হয়নি। বাংলাদেশে ২০২০ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে এমন সমালোচনা করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পুলিশ ও অন্য আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলো অব্যাহতভাবে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারিকালে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চিটাগাং হিলট্রাক্টস এগ্রিমেন্ট স্থবির অবস্থায় রয়েছে। উপজাতীয় অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন তীব্র হয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। তাতে এবার বাংলাদেশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৮ই মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্তের খবর নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে, সংক্রমণ দেশজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়। আভ্যন্তরীণ চাহিদায় মন্দা এবং রপ্তানির মারাত্মক পতন হওয়ায় এখানে অর্থনীতিতে দু’দফা আঘাত লাগে। অর্থনৈতিক হতাশা থেকে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন গার্মেন্ট শিল্প এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের কম বেতনভোগী লাখ লাখ শ্রমিক। ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা ছিল যত্রতত্র। এসব কেলেঙ্কারি নিয়ে যেসব সাংবাদিক বা সংবাদ মাধ্যম রিপোর্ট করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ বেশি থেকে বেশি নিপীড়ন চালিয়েছে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধান থাকার কারণে কোনো র‌্যালি বা বিক্ষোভ হতে পারে নি।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে কড়া সমালোচনা করা হয়। বলা হয়, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে দমিয়ে রাখতে, সাংবাদিক ও মানবাধিকারের পক্ষের ব্যক্তিদের টার্গেট ও হয়রান করতে সরকার অব্যাহতভাবে ব্যবহার করেছে বিতর্কিত এই আইনটি। এই আইন থেকে বিতর্কিত এবং শাস্তিমূলক বিধানগুলো বাদ দেয়ার জন্য নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো বার বার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও, তা সংশোধন করা হয়নি।

অ্যামনেস্টি লিখেছে, সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এই আইনের অধীনে কমপক্ষে ৯০০ মামলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার মানুষের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়েছে। আটক রাখা হয়েছে ৩৫৩ জনকে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন এজেন্সি ও সরকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিরা কমপক্ষে ২৪৭ জন সাংবাদিকের ওপর হামলা, হয়রান এবং ভীতি প্রদর্শন করেছেন। লকডাউনের সময় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য দেয়া ত্রাণসামগ্রী লুটপাটের রিপোর্ট প্রকাশ করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এপ্রিলে অভিযুক্ত করা হয় জাগোনিউজ২৪-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার এবং বিডিনিউজ২৪-এর প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদির বিরুদ্ধে। তাদের দু’জনকেই হাইকোর্ট থেকে জামিন দেয়া হয়েছে। তারা বছরের শেষ পর্যন্ত বিচারের অপেক্ষায় ছিলেন।

ঘোড়াশাল পুলিশ স্টেশনে নিরাপত্তা হেফাজতে এক ব্যক্তির মৃত্যুর রিপোর্ট করার কারণে মে মাসে দৈনিক গ্রামীণ দর্পন পত্রিকার বার্তা সম্পাদক রমজান আলি প্রামাণিক এবং স্টাফ রিপোর্টর শান্তা বণিক, অনলাইন নরসিংদী প্রতিদিনের প্রকাশক ও সম্পাদক খন্দকার শাহিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টাকে নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের জন্য জুন মাসে অভিযোগ গঠন করা হয় ইনকিলাব পত্রিকার সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দিনের বিরুদ্ধে। বছরের শেষ পর্যন্তও ওই মামলার বিচার মুলতবি অবস্থায় ছিল।

মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধীনে শান্তিপূর্ণভাবে মত প্রকাশ করার কারণে নিপীড়িত হতে হয়েছে শিক্ষাবিদদেরও। জাতীয় একটি পত্রিকায় মতামত কলামে একটি প্রতিবেদন লেখার কারণে সেপ্টেম্বর মাসে প্রফেসর মোর্শেদ হাসান খানকে বরখাস্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ফেসবুকে একটি মন্তব্য পোস্ট করার কারণে প্রফেসর একেএম ওয়াহিদুজ্জামানকে বরখাস্ত করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জাতীয় সংসদের  ক্ষমতাসীন দলের মৃত একজন সদস্যকে নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করার কারণে জুনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন প্রফেসরকে বরখাস্ত করা হয়।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আরো লিখেছে, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। মার্চের পর করোনা মহামারির কারণে আউটডোরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা ছিল সীমিত। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ইনডোর মিটিংকেও টার্গেট করেছে কর্তৃপক্ষ। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪৪ ধারা ব্যবহার করে সরকার ১৭টি জনসমাবেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া অন্য রাজনৈতিক সমাবেশ হয়তো কর্তপক্ষ বন্ধ করে দিয়েছে, না হয় ছত্রভঙ্গ করেছে। জানুয়ারিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মেয়রপ্রার্থীর ওপর শারীরিক হামলা চালায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সদস্যরা। এতে ওই প্রার্থী ও তার বেশ কয়েকজন সহকর্মী আহত হন।

বিএনপি এবং তার অঙ্গসংগঠন দেশজুড়ে ধারাবাহিক মিটিং আয়োজন করে ফেব্রুয়ারিতে। এ সময় তাদের ওপর লাটিচার্জ করে এবং সহিংসভাবে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়েছে। জুলাই মাসে কোনো প্ররোচণা ছাড়াই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নবগঠিত একটি দল আমার বাংলাদেশ পার্টির একটি ইনডোর আলোচনা বন্ধ করে দেয় পুলিশ।

ঢাকায় স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট এক শিক্ষার্থীকে মুক্তির দাবিতে আগস্ট মাসে দক্ষিণের জেলা বরগুনায় শান্তিপূর্ণ র‌্যালি ও মানববন্ধন করছিল জনতা। কিন্তু তাদেরকে সহিংসভাবে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে পুলিশ। ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে কোনো সহিংসতা বা প্ররোচণা না থাকলেও মানববন্ধন ভেঙে দেয় পুলিশ।

বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও জোরপূর্বক গুম নিয়েও রিপোর্ট করেছে অ্যামনেস্টি। এতে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা কমপক্ষে ২২২ জনকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার না করেই হত্যা করা হয়েছে ১৪৯ জনকে। ৩৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে গ্রেপ্তারের পরে। অন্যরা মারা গিয়েছেন নির্যাতন বা অন্য ঘটনায়। কমপক্ষে ৪৫ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে এমন হত্যার শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এর বেশির ভাগই মারা গেছে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অভিযানে। গত বছরে জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটেছে ৯টি। এর মধ্যে রয়েছেন একজন কলেজ শিক্ষক, একজন সম্পাদক, একজন ব্যবসায়ী, দু’জন শিক্ষার্থী, বিরোধী দলের চারজন কর্মী। তিনজনকে পরে ‘খুঁজে পেয়েছে’ পুলিশ। এরপর তাদেরকে আটক করা হয়েছে। নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনের তীব্র প্রতিবাদের ফলে ৪৮ ঘন্টা পরে অজ্ঞাত জিম্মিকারীরা মুক্তি দিয়েছে একজন ছাত্রনেতাকে। একজন রাজনৈতিক নেতাকে পাওয়া গেছে মৃত। বছরের শেষ নাগাদ অন্য চারজন ছিলেন নিখোঁজ।

রিপোর্টে বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার দিকেও দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, বছরজুড়ে নারীর বিরুদ্ধে কমপক্ষে ২৩৯২টি সহিংসতা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৬২৩টি ধর্ষণ।  তার মধ্যে আবার ১২ বছরের কম বয়সী ৩৩১ টি বালিকা ধর্ষিত হয়েছে। ৩২৬টি ঘটেছে উদ্দেশ্যমূলক ধর্ষণ। ৪৪৩টি ঘটেছে শারীরিক অবমাননা। শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের উদ্দেশে কমপক্ষে ৪৪০ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। অক্টোবরে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, একজন নারীর পোশাক খুলে নেয়া হচ্ছে। তাকে লাথি, ঘুষি দিচ্ছে ৫ সদস্যের একদল পুরুষ। তারা তাকে যৌন নির্যাতন করছে। এই ঘটনাটি ২রা সেপ্টেম্বরের বলে মনে করা হয়। এর ফলে ব্যাপক জনঅসন্তোষ এবং দেশজুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়।

Please follow and like us:

Check Also

‘জলবায়ুু পরিবর্তন’ —– ঝুঁকিতে উপকূলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি

বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা দুই লাখ ৪০ হাজার কৃষকের আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষীরাঃ ‘জলবায়ুু পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।