ঈদুল আযহার প্রস্তুতি : জিলহজের প্রথম দশকের আমল -বিলাল মাহিনী

প্রতি বছর মুসলমানদের সর্ববৃহৎ সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয় পবিত্র হজ্ব ও ঈদুল আযহায়। এ সময় পৃথিবীর প্রায় অর্থ কোটি মুসলমান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পবিত্র মক্কা-মদিনায় সমবেত হন হজ্বের উদ্দেশ্যে। এছাড়া সারা দুনিয়ার মুসলমানগণ নিজ নিজ এলাকার ঈদগাহে শামিল হন ঈদুল আযহার সালাত আদায় ও হালাল পশু কুরবানির জন্য। জিলহজ্বের কয়েক মাস আগে থেকেই হজ্ব এবং এর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। আর ঈদুল আযহা ও কুরবানীর প্রস্তুতি শুরু হয় জিলহজ্ব মাসের প্রথম দিন থেকেই। আসুন জেনে নিই, জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ দিনের করণীয় সমূহ।

জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ, এই ছয় দিন হজের মূল কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। অন্যদিকে এ মাসের ১০ তারিখে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্তে পশু কুরবানী করেন। এই দুই ইবাদতসহ নানা কারণে এ মাসের মর্যাদা ও ফজিলত অন্য মাসগুলো থেকে অনেক বেশি। এ দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘শপথ ভোরবেলার! শপথ ১০ রাতের’ (সূরা ফজর : ১-২)! এখানে ১০ রাতের শপথ দ্বারা জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনই উদ্দেশ্য (তাফসিরে ইবনে কাসির)।

বর্ণিত আয়াতে ১০ রাতের শপথ দ্বারা জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন উদ্দেশ্য বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন আল্লামা ইবনে কাসির রহ.। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘জিলহজের ১০ দিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে অন্যদিনের ইবাদতের তুলনায় বেশি প্রিয়। প্রতিটি দিনের রোজা এক বছরের রোজার মতো আর প্রতি রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের মতো।’ তিরমিজি : ১/১৫৮।
ইবন ওমর রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সা. বলেছেন, আল্লাহর কাছে কোনো দিনই প্রিয় নয়, আর না তাতে আমল করা, এ ১০ দিনের তুলনায়। সুতরাং তোমরা তাতে (জিলহজের প্রথম ১০ দিন) বেশি বেশি তাহলিল, তাকবির ও তাহমিদ পাঠ করো’ (তাবারানি)।

জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার পর থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত রোজা পালন, বেশি বেশি নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-দরূদ ও তওবা-ইস্তেগফারসহ বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগি করা আল্লাহর কাছে প্রিয় আমল। আলেমগণ এগুলোকে জিলহজের প্রথম ১০ দিনের বিশেষ আমল বলে অভিহিত করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘তারা যেন নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর স্মরণ করে।’সুরা হাজ : ২৮। আয়াতে নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর স্মরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, ‘(এ নির্দিষ্ট দিনসমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য) জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন।’

অন্যদিকে আরাফাতের দিন অর্থাৎ ৯ জিলহজ নফল রোজা রাখা বিশেষ সুন্নত আমল। তবে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হাজিদের জন্য এই রোজা প্রযোজ্য নয়। হজরত আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আরাফাতের দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী যে আল্লাহতায়ালা তার (রোজাদারের) বিগত এক বছরের ও সামনের এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ তিরমিজি শরিফ : ১ / ১৫৭।

এ ছাড়া ৯ জিলহজ ফজরের নামাজের ওয়াক্ত থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতি ফরজ নামাজের পর একবার তাকবির বলা ওয়াজিব। জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ যেকোনো দিন, কোনো ব্যক্তির মালিকানায় নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা এর সমমূল্যের সম্পদ থাকলে তার ওপর কুরবানী করা ওয়াজিব। পুরুষ ও নারী সবার জন্য এ বিধান প্রযোজ্য।

হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম রা. বর্ণনা করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ সা.-এর কাছে সাহাবারা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এ কুরবানী কী? উত্তরে তিনি বললেন, তোমাদের পিতা ইবরাহিম আ.-এর সুন্নত। তারা পুনরায় বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! তাতে আমাদের জন্য কী সওয়াব রয়েছে? উত্তরে তিনি বললেন, কুরবানীর পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি সওয়াব রয়েছে। তারা আবারো প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! ভেড়ার লোমের কী হুকুম? (এটা তো গণনা করা সম্ভব নয়) তিনি বললেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি সওয়াব রয়েছে।’ ইবনে মাজাহ : ২২৬।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রা. থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আমাকে প্রতি আজহার দিন (১০ জিলহজ) ঈদপালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যা আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মদির জন্য নির্ধারণ করেছেন। তখন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি বলুন, (যদি আমার কুরবানীর পশু কেনার সামর্থ্য না থাকে) কিন্তু আমার কাছে এমন উট বা বকরি থাকে। যার দুধ পান করা বা মাল বহন করার জন্য তা প্রতিপালন করি। আমি কি তা কুরবানী করতে পারি? তিনি বললেন, না। বরং তুমি তোমার মাথার চুল, নখ, গোঁফ কেটে ফেলো এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করো। তা আল্লাহর কাছে তোমার কোরবানি।’ আবু দাউদ : ৩০৫।

বর্ণিত হাদিসসমূহের আলোকে আলেমরা জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের ইবাদতে একনিষ্ঠভাবে নিজেদের নিয়োজিত করতেন। নবী কারিম সা. জিলহজ মাসে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর এক বর্ণনায় এসেছে, ‘যখন জিলহজ মাসের ১০ দিন শুরু হতো, তখন তিনি খুব মুজাহাদা (পরিশ্রম) করতেন, যেন তার ওপর তিনি শক্তি হারিয়ে ফেলবেন।’ (দারেমি)
মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের হজ¦ ও কুরবানী কবুল করুন। আমাদের ইবাদতসমূহ কবুল করুন। (আমিন)

বিলাল মাহিনী / পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিলমাদরাসা, প্রতিষ্ঠাতা ও  নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, জীবন সদস্য : নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট, অভয়নগর, যশোর।

Please follow and like us:

Check Also

বেড়িবাঁধ কেটে নোনাপানি ঢুকিয়ে ঘের ব্যবসা

সুন্দরবন–সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলায় যত্রতত্র বেড়িবাঁধ কেটে ও ছিদ্র করে পাইপ দিয়ে নোনাপানি উঠিয়ে চলছে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।