গণমানুষের বঙ্গবন্ধু – সৈয়দ এমদাদুল হক*

“একদিন বঙ্গবন্ধু গাড়িতে চেপে ঢাকা থেকে বাড়ি যাচ্ছেন। বাড়ি পৌঁছার অদূরে রাস্তার পাশে চোখ দিতেই এক চেনা মানুষের মুখ ভেসে উঠলো। তিনি ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন। যথারীতি গাড়ি থামলো। বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে নামলেন। দেখলেন তাঁরই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক জল-কাদায় মাছ ধরছেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষকের পায়ে সালাম করে জিজ্ঞাসা করলেনÑ স্যার! কেমন আছেন? স্যার বললেনÑ কেমন আছি জিজ্ঞাসা কর? মাছ বেচে জীবন চালায়। জানতো বে-সরকারি প্রইমারি স্কুলের মাষ্টারদের মাসিক মাইনে নেই। অবসর ভাতা নেই। তুমি তো সরকারে আছ! যদি পার তবে এ মাষ্টারদের জন্য কিছু করো। বঙ্গবন্ধু ঢাকা ফিরলেন। মন্ত্রীবর্গের আদেশ দিলেন,Ñ দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষকদের তালিকা প্রস্তুত কর।” বঙ্গবন্ধু তাঁর শিক্ষকে স্মরণে রেখে ঋণ শোধাবার চেষ্টা করলেন প্রথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের মাধ্যমে।
আমরা হাতাকাটা কালো যে মুজিবকোর্ট দেখতে পাই, তারও ইতিহাস আছে,Ñ “একবার বঙ্গবন্ধু লালবাগ মাদ্রাসার উস্তাদ মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী’র নিকট দোয়া চাইতে লালবাগে এসেছিলেন, তখন উস্তাদ ভালোবাসা স্বরূপ গায়ের কোর্টটি বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেন। বঙ্গবন্ধু কোর্টটি সম্মানে গায়ে জড়িয়ে নিলেন।”
উপরোক্ত দু’টি উদাহরণ প্রমাণ স্বরূপÑ বঙ্গবন্ধু জন্ম-মৃত্যু অবধি বাংলার খেটে খাওয়া নিপীড়িত-বঞ্চিত শ্রমিক শ্রেণির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে সমর্পিত করে রেখেছিলেন। কৈশোরে বন্ধুদের নিয়ে তিনি দুরন্তপনায় মেতে উঠেছেন। তিনি সম-বয়সীদের সাথে মিলে গাছে চড়েছেন এবং পুকুরের পানিতে জল-কুমির খেলা করেছেন। তাঁর বড়গুণ ছিলোÑ গ্রামের মানুষকে তিনি কখনো ভোলেননি। অনা-বৃষ্টি, অতি বৃষ্টিতে গ্রামের কৃষকদের খাবার ও বীজ ধান নষ্ট হয়েছে বলে নিজ গোলার ধান কৃষকদের মাঝে বিলি করছেন। গায়ের জামা-চাদর গরীবদের দিয়েছেন। তিনি ছাত্রজীবনে মুষ্টিভিক্ষা করে দরিদ্র মেধাবি ছাত্রদের পড়া-লেখা চালিয়ে নিয়েছেন। তৎকলের অবিভক্ত বাংলার মূখ্য মন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুল পরিদর্শনে এলে বঙ্গবন্ধু পথরোধ করে স্কুলের ছাদ সারাই ও ছাত্রবাস নির্মণের দাবী তুলে , তা আদায় করেন।
“আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না”Ñ বঙগবন্ধু তাহলে কি? চেয়েছিলেন। তিনি বলেছেন,Ñ “আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্য পায়, বস্ত্র পায়, বাসস্থান পায়, শিক্ষার সুযোগ পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।” বঙ্গবন্ধু আন্তঃধর্মীয় সম্প্রতীর বন্ধনে গোটা বাঙালিকে ঐক্যবন্ধ করেন। তাঁর চিন্তা মানসে গঠিত ছিল,Ñ বাংলার মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্ট্রান ও অন্যান্য জনগোষ্ঠি মিলে একটি কর্যকর শক্তিশালী জাতীয়তাবোধ সম্পন্ন রাষ্ট্রগঠনে সচেষ্ট হবে।
দুই
শতবর্ষ আগে বঙ্গবন্ধু যে সময়ে জন্মেছিলেন, সে সময় ভারতবাসীর মুক্তি সংগ্রামের কাল। সৃষ্টি বিনাশী প্রথম সমরের উত্তরকালে পৃথিবীব্যাপি অর্থনৈতিক মন্দা ও রাজনৈতিক হতাশার মধ্যে বৃটিশদের ভারত ছাড়ো আন্দোলন ফুঁসে উঠেছিল। গান্ধীজীর অসহোযোগ আন্দোলনের সাথে মুসলিমলীগের খেলাফত আন্দোলন একীভূত হয়ে চরম অসহোযোগ আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করলো। আবার সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সাথেই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হল। এরপর ভারত শাসন আইন উত্থাপিত হলো, এ রাজনৈতিক ক্রিয়া বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করলো। বঙ্গবদ্ধু জড়িয়ে পড়েন পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে।
পাকিস্তান আন্দোলনের ফলস্বরূপÑ বিভক্ত হলো অখÐ ভারত ভূমি, দু’টি ভূ-সীমা রেখায়Ñ পাকিস্তান ও ভারত। পাকিস্তান আবার, পশ্চিম পাকিস্তান এবং বার’শ মাইলের দূরত্বের পূর্ব পাকিস্তান। এ দু’অঞ্চলের ভাষাগত পার্থক্যের ফলে বাংলা ভাষাভাষী এ বঙ্গের জন-মানুষ ভাষার প্রশ্নে প্রথম প্রতিবাদ গড়ে তোলে পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিপক্ষে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত বৈঠাকে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবক্রমে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রম পরিষদ’ (১৯৪৮) গঠিত হয়।
২৩ জুন, ১৯৪৯ সনে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিমলীগ (পরে আওয়ামীলীগ) গঠিত হলে শেখ মুজিবুর রহমান তার অন্যতম প্রতিষ্ঠা সদস্য ছিলেন। তৎকালের প্রথম বিরোধীদল হিসেবে আবিভূত আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে তাঁর মানস গঠিত।
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’এ যুক্তফ্রান্ট গঠন ও নির্বাচনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন ও  বাঙালির মুক্তির সনদ ৬৬’র দফা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকের রোষানলে পড়লেন। তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হলো, জেল হলো। ৬৯’র গণ-অভুত্থান চলাকালে তিনি “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত হলেন। ৭০’ নির্বাচনে জনগণের রায় পেয়েও বাঙালিরা দেশ শাসনের ক্ষমতা না পেয়ে আন্দোলন করলে পাকিস্তানি দমন-নিপীড়িন নেমে আসে।                                                                                                                                                                                                                                                                    ৭১’র সময় তিনি বাঙালির কাÐরি হিসেবে পল্টনে ৩রা, মার্চ ও রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চের  মহা-কাব্যিক ভাষণ দেন। ২৫শের কালো রাতের পর বঙ্গবন্ধু সেনাদের হাতে ধৃত হলেন, করাচি জেলের পাশে খোঁড়া হলো কবর। মুক্তিযুদ্ধ ও নয়মাস রাক্ত¯œানের পর ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এর চূড়ান্ত বিজয়। বঙগবন্ধুর নেতৃত্ব-সংগ্রামে, বাঙালির আপামর জন-সাধারণের স্ব-স্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়।
জন-মানুষের প্রাণ ভালোবাসায় সিক্ত বঙ্গবন্ধু একদিন অন্তর্জাতিক রাজনীতিবিদ হয়ে উঠলেন। তাঁর প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক দূরদর্শিতার ফলে সদ্য স্বাধীনপ্রাপ্ত বাংলাদেশ ১২১টি দেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি আদায়ে সমর্থ হয়। বাংলাদেশ ৭২ সালে জেট নিরেপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য, ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্য পাদ লাভ ও ওআইসি সদস্য পদ লাভের জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা নিরান্তর।
তাছাড়া তিনি ৭৩-এ আলজিয়ার্সে প্রেসিডেন্ট হুয়ারী বুমেদিনের আমন্ত্রণে জোট নিরেপেক্ষ দেশ সমূহের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করে অন্যান্য দেশের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন এবং ২৩ ফেব্রæয়ারি, ১৯৭৪ সালে লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়ে মুসলিম বিশে^র সাথে বাংলাদেশর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ও বাংলাভাষাকে বিশ^ মাঝে তুলে ধরেছিলেন ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘বাংলা ভাষা’য় ভাষণ দানের মাধ্যমে। এ সকল সফলতার ফল স্বরূপ ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ‘জুলিওকুরি’ পদকে ভূষিত হলেন। বঙ্গবন্ধু মিশে গেছেন গণ-মানুষের কাতারে, জন-মানুষের মনে চির অমলিন হয়ে।
আলোচনার প্রান্তিক পর্বে বলা যায়,Ñ বাঙালির অস্তিত্ব সংগ্রাম ও মুক্তি আন্দোনের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি নিজ কর্মবলে, মেধা-প্রজ্ঞায় জন-মানুষের কাছে সমাদৃত ও জনপ্রিয় অবিসংবাদিত নেতা হতে পেরেছিলেন। তাঁর চরিত্রে মানবিকতা, সহনশীলতার গুণ যেমন ছিল তেমনি ছিল তেজস্বিতা ও আপসহীনতা। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি, বাংলার এই মৃত্তিকায়, জল-আবহাওয়ায়।
সূত্র:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ধর্ম মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ যশোর জেলা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ৯৯তম জন্ম-বার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস ২০১৯ খ্রি. উদ্যাপন উপলক্ষে “বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনী” সম্পর্কে আলোচনা সভার স্মারক বক্তৃতা।
লেখকঃসৈয়দ এমদাদুল হক,
প্রভাষক,সিঙ্গিয়া আদর্শ কলেজ,যশোর।
Please follow and like us:

Check Also

বেড়িবাঁধ কেটে নোনাপানি ঢুকিয়ে ঘের ব্যবসা

সুন্দরবন–সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলায় যত্রতত্র বেড়িবাঁধ কেটে ও ছিদ্র করে পাইপ দিয়ে নোনাপানি উঠিয়ে চলছে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।