বার্ধক্যে পিতামাতা ও স্বজনদের খেদমত -বিলাল মাহিনী

মানব জীবনের সব সাফল্যের ভিত্তি হলো পিতা-মাতা। আর স্বজন ছাড়া মানুষ কাঙাল, অনর্থক জীবন। আমাদের স্বর্গতুল্য পিতা-মাতা ও স্বজনেরা বার্ধক্যে উপনীত হলে আমাদের কাছে বোঝা মনে হয়। ঝামেলা মনে হয়। ফল হিসেবে অনেক পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে জীবন কাটাতে হয়। অনেককেই ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন কাটাতে হয়। অথবা অনেককেই একাকী জীবন কাটাতে হয়। সন্তানেরা নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেকেই অতি-আধুনিকতাকে লালন করতে গিয়ে শহুরে জীবন বেছে নেন। কেউ কেউ আবার একক বা ক্ষুদ্র পরিবার গড়তে পিতা-মাতাকে দূরে ঠেলে দেন। পিতা-মাতার খোঁজ নেওয়ার ফুরসতও কারও কারও হয় না।

শ্রীমদভগবদ্ গীতায় বলা হয়েছে, ‘হিন্দু ধর্মে পিতা মাতা কে সর্বাধিক সম্মান দেওয় হয়েছে। পিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম পিতাহিপরমন্তপ পিতরী প্রিতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা’ এখানে পিতাকে স্বর্গ এবং ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জননী সম্পর্কে সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, ‘জননী জন্মভুমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী’। অর্থাৎ স্বর্গের থেকেও উপরে আমাদের মা এর স্থান।

সামাজিকভাবে বাঙালিরা একসময় বৃহৎ পরিবারে বসবাস করতো। তখন বার্ধক্যে থাকা মানুষগুলো নাতি-নাতনি নিয়ে সময় কাটাতো। সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে মানুষ পিতা-মাতা, দাদা-দাদী ও বৃদ্ধ স্বজনদের থেকে দূরে থাকা বা তাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখাকে খুব অপরাধ বলে মনে করতো। কিন্তু আজকের সমাজে সামাজিক, পারিবারিক, নৈতিক বা ধর্মীয় মূল্যবোধ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। অথচ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-‘পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাঁদের কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন তা হলে তাঁদের সঙ্গে “উহ’’ শব্দটিও বলোনা। তাদের ধমক ও দিয়ো না। তাদের সঙ্গে শিষ্টতাপূর্ণ কথা বলো। তাদের সামনে ভালোবাসার সঙ্গে বিনম্রভাবে মাথানত করে দাও এবং বলো, হে পালনকর্তা তাঁদের উভয়ের প্রতি দয়া করুন, যেমনটি তাঁরা আমাদের শৈশব কালে করেছেন’ (সুরা বনি ইসরাঈল, ২৩- ২৪)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে কুরতুবিতে লেখেন, ‘আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতের মধ্যে পিতা-মাতার প্রতি আদব, সম্মান এবং তাঁদের প্রতি সদ্ব্যবহার করাকে নিজের ইবাদতের সঙ্গে একত্রিত করে ফরজ করেছেন।

বার্ধক্য একটি স্বাভাবিক জৈবিক ঘটনা এবং মন্থর ও আনুক্রমিক গতিতে এগিয়ে আসা দৈহিক অবক্ষয়, যার ফলে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে কর্মক্ষমতা এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। এর অবধারিত পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু। সাধারণভাবে বার্ধক্য দ্বারা প্রায়ই বয়োবৃদ্ধির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। এটি অবশ্যম্ভাবী জৈবিক বাস্তবতা, এর একটা নিজস্ব গতি রয়েছে এবং বিভিন্ন প্রতিরোধক আবিষ্কার সত্ত্বেও তা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।(বাংলাপিডিয়া)
বার্ধক্য, বৃদ্ধাবস্থা বা জরা মানব জীবনের শেষ ধাপ। বার্ধক্যে পৌঁছোবার বয়স জনে জনে ভিন্ন হতে পারে। মানুষের জীবনের শিশুকাল, কৈশোর ও যৌবনকাল পার করে বার্ধক্য আসে। প্রতিটি মানব কোষে অজস্র (নির্দিষ্ট সংখ্যক) ডি,এন,এ রয়েছে, আর তারই একটা ছোট্ট অংশকে বলা হয় জিন। এই জিন গুলোই আমাদের বংশগতির ধারক ও বাহক। আর এই জিন জনিত কারণকেই এখনো বৃদ্ধ হবার প্রধান কারণ হিসেবে তাত্ত্বিক ভাবে ধরে নেয়া হয়। (ইউকিপিডিয়া)

বাংলাদেশের মানুষের বয়সসীমা ৪০ বৎসর পার হওয়ার পর থেকে বার্ধক্য জনিত নানা ধরনের সমস্যা দেখা যায়। সাধারণত এইসময়ে মানুষ হৃদরোগ, হাড়ের ক্ষয়সহ বিভিন্ন ধরনের রোগ ব্যধিতে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীণ মানুষই কতগুলি মৌলিক মানবিক সমস্যার শিকার হচ্ছে; এসবের মধ্যে রয়েছে অপর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থান, বার্ধক্যজনিত রোগ এবং যথোপযুক্ত সেবা ও চিকিৎসা সুবিধার অভাব, একাকিত্ব ও অবহেলা, বঞ্চনা এবং আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। প্রবীণদের দেখাশোনার ব্যাপারে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য রয়েছে এবং প্রত্যাশা থাকে যে পরিবার ও সমাজ তাদের প্রবীণ সদস্যদের যত্ন নেবে। কিন্তু দ্রুত আর্থ-সামাজিক ও জনতাত্ত্বিক পরিবর্তন, ব্যাপক দারিদ্র্য, ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব এবং অন্যান্য কারণে ঐতিহ্যবাহী যৌথ পারিবারিক ও সামাজিক দেখাশোনার পদ্ধতি ভেঙ্গে পড়েছে।

বার্ধক্য আসলে মানুষের নানা রকম সমস্য শুরু হয়। মানুষ কর্মক্ষমতা হারায়। স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতি মানুষের যে কর্তব্য তা যথাযতভাবে পালন করা সম্ভব হয় না বার্ধক্যে। তাইতো বিশ্বনবী স. বার্ধক্য থেকে অর্থাৎ বার্ধক্যের পীড়ন থেকে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারিম স. দোয়া করতেন, হে আল্লাহ! আমি অলসতা, অতি বার্ধক্য, ঋণ আর পাপ থেকে আপনার আশ্রয় চাই। ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার আশ্রয় চাই জাহান্নামের আজাব, জাহান্নামের ফেতনা, কবরের আজাব, প্রাচুর্যের ফেতনার কুফল, দারিদ্র্যের ফেতনার কুফল এবং মাসিহে দাজ্জালের ফেতনা থেকে। ইয়া আল্লাহ! আপনি আমার সমুদয় গোনাহ বরফ ও শীতল পানি দিয়ে ধুয়ে দিন। আমার অন্তর যাবতীয় পাপ থেকে পরিচ্ছন্ন করুন, যেভাবে সাদা কাপড় ময়লা থেকে পরিচ্ছন্ন করা হয়। আমার ও আমার গোনাহগুলোর মধ্যে এতটা ব্যবধান করে দিন যতটা ব্যবধান আপনি পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের মধ্যে করেছেন। (সহিহ্ বুখারি : ৫৯৩৫)

হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. বলেন, নবী কারিম স. যেসব বাক্য দিয়ে আল্লাহর আশ্রয় চাইতেন, সে সব বাক্য দ্বারা তোমরাও আশ্রয় চাও। তিনি বলতেন, ইয়া আল্লাহ! আমি কাপুরুষতা থেকে, আমি কৃপণতা থেকে আপনার আশ্রয় চাই। আমি বয়সের অসহায়ত্ব থেকে আপনার আশ্রয় চাই। আর আমি দুনিয়ার ফেতনা ও কবরের আজাব থেকে আপনার আশ্রয় চাই। (সহিহ্ বোখারি : ৫৯৩৪)

আজকের সমাজের মানুষকে এটা বুঝতে হবে বার্ধক্যকালীন সময় একজন মানুষের জীবনে একটা কঠিন সময়। তাই, এ সময় যাতে আমাদের পিতামতা ও স্বজনেরা হাহাকার না করেন, একাকিত্ব বোধ না করেন, খাবার ও চিকিৎসার জন্য কষ্ট ভোগ না করেন সেজন্য তাঁদেরকে সময় এবং যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।
আমাদের দেশে বার্ধক্যে উপনীত হওয়া ব্যক্তিদের জন্য  প্রথাগত ঐতিহ্যবাহী সেবাগুলির মধ্যে রয়েছে আত্মীয় ও পরিবারের সেবাযত্ন, দয়াদাক্ষিণ্য ও ভিক্ষা প্রদান, এবং মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থান, মাযার, দরগাহ ইত্যাদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় প্রদান। ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময় সরকার বয়স্ক ভাতা নামে একটি নতুন পেনশন প্রকল্প চালু করে। এর আওতায় প্রতিটি ইউনিয়ন/ওয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র ১০ জনকে (৫ জন পুরুষ ও ৫ জন মহিলা) প্রতি মাসে ১০০ টাকা হারে ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু গ্রাম বা শহর অঞ্চলে বসবাসকারী সকল দরিদ্র প্রবীণদের জন্য কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।

কিন্তু পারিবারিকভাবে আগে যেভাবে বৃদ্ধ পিতামাতা বা স্বজনদের দেখাশুনা করা হতো, এখন তাতে ভাটা পড়েছে। সন্তানেরা তো শিখবে আমাদের দেখে। আজ যাঁরা সন্তান, আগামী দিনে তাঁরাই হবেন পিতা-মাতা। আজ যাঁরা বধূ বা জামাতা, আগামীকাল তাঁরাই হবেন শ্বশুর বা শাশুড়ি। সুতরাং, আজকের সন্তানেরা যদি তাঁদের পিতা-মাতার খেদমত করেন, তবে তাঁদের সন্তানেরা তাঁদের থেকে দেখে শিখবে কীভাবে পিতা-মাতার খেদমত করতে হয় এবং তাঁদের বার্ধক্যেও তাঁরা তাঁদের সন্তানের কাছ থেকে অনুরূপ খেদমত পাবেন।

যারা আমাদের এই পৃথিবীতে এনে এর অফুরন্ত সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ করে দিল তাদের আমরা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমরা কী একবারও ভাবছি, খুব অসহায় অবস্থায় একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে। পৃথিবীতে এসে পিতা-মাতার যথাযথ লালন-পালন, আদর, স্নেহ, মমতা ও শিক্ষা-দীক্ষার মাঝে বেড়ে ওঠে সন্তান। আর সেই পিতা-মাতাকে ভরণপোষণ না দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির পথে ঠেলে দিচ্ছি। রোগাক্রান্ত হলে সেবা যতœ না করে রাস্তায় ফেলে যাচ্ছি। অনেক কুলাঙ্গার সান রয়েছে যারা বাবা-মাকে মারধর পর্যন্তও করে বলে শোনা যায়। একটি সমাজে যখন নীতি-নৈতিকতার চরম বিপর্যয় ঘটে তখন ফল হিসেবে পিতা-মাতা ও স্বজনদের এমন করুণ পরিণতি পোহাতে হয়। আমাদের শিষ্টাচারিতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ যখন তলানিতে গিয়ে পৌঁছে তখন পিতা-মাতাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সেবাশুশ্রুষা প্রাপ্তির বদলে নিগৃহীত ও অত্যাচারিত হতে হয়।
অথচ, ইসলাম বলছে, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহশত’। ‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি’। তাছাড়া হুযুর স. বলেন, ‘তোমরা তোমাদের পিতা-মাতার বন্ধু-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার করো’। তাই আসুন, আমরা জীবনের চরম ও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে যেনো বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও আমাদের স্বজনদের (চাচা-চাচি, ফুফা-ফুফু, মামা-খালাসহ নিকটাত্মীয়) ভুলে না যাই। সামর্থ্যমতো তাদের সেবা করতে পারি। তাহালে আমাদের উত্তরসূরীরাও বার্ধক্যে আমাদের সেবা করবেন। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সকলকে বার্ধক্যে উপনীত হওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তৌফিক দান করুন। আমিন।

বিলাল মাহিনী / পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, প্রতিষ্ঠাতা ও  নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর । যুগ্ম সম্পাদক- ভৈরব-চিত্রা রিপোর্টার্স ইউনিটি। জীবন সদস্য- নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট। কাজের ক্ষেত্র : কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সাহিত্য-সংস্কৃতি শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা।

Please follow and like us:

Check Also

বেড়িবাঁধ কেটে নোনাপানি ঢুকিয়ে ঘের ব্যবসা

সুন্দরবন–সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলায় যত্রতত্র বেড়িবাঁধ কেটে ও ছিদ্র করে পাইপ দিয়ে নোনাপানি উঠিয়ে চলছে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।