শুধু নিরাপদ সমাজ নয়, নারীর প্রতি শালীন ও পজিটিভ মন্তব্যও কাম্য – তানজিলা ঐশী

 

আমাদের নারীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্ধেক। তাঁরাও মানুষ। পুরুষের ন্যায় নারীও সমান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা।

হ্যাঁ নারীর প্রতি এখন দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সর্বত্র পজিটিভ চিন্তা আসেনি এখনো। আমরা এমন জেনারেশনের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছি যেখানে ছোটবেলা থেকেই সবাই শুনে-জেনে-দেখে বড় হচ্ছে যে, “ছেলে-মেয়ে সমান” । আর এ বিষয়ে অনেক ছোট থেকেই আমাদের পাঠ্যপুস্তকেও নানান তথ্য বা উক্তি দেওয়া থাকে৷ মূলত প্রাথমিক লেভেল অর্থাৎ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে “ছেলে-মেয়ে সমান” এই ব্যাপারটা নিয়ে কোনরকম সন্দেহ থাকে না। কিন্তু আমাদের জলবায়ুগত কারণে হোক আর সময়ের পরিক্রমায় হোক, মাধ্যমিক পর্যায়ে অর্থাৎ হাইস্কুলে পদার্পনের সাথে সাথেই ছেলে-মেয়ে উভয়ের শারীরক পরিবর্তন হতে শুরু হয়। আর এই শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে “ছেলে-মেয়ে সমান” সেই ধারণারও পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়।

নারীর প্রতি এই পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটেও প্রভাব ফেলে। আমাদের সমাজে একটা মেয়েকে সবচেয়ে বেশি বিচার করা হয় তাকে কেমন দেখতে এটার উপর। যেটা মোটেও কাম্য নয়।

কিছু মানুষ বলতে পারে, না সবাই এমন না, সবাই এমন চিন্তা করে না, সবার কাছে বাহ্যিক সৌন্দর্য্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না। হ্যাঁ, ঠিক আছে, সে ব্যতিক্রম। আর ব্যতিক্রমটা কখনো উদাহরণ হয় না।

কিন্তু প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশের অনেক মেয়েদের এমন কিছু মানুষের মুখোমুখি হতে হয় যারা খুব বাজে ভাবে একটা মেয়েকে মানসিক সমস্যায় ফেলে দিতে পারে শুধুমাত্র তার বাহ্যিক ধরন বা তার চেহারার জন্য। যেমন -মেয়েটা খাটো, মেয়েটা মোটা, অনেক চিকন, কালো, মেয়েটার মাথায় চুল কম, মেয়েটার বডি স্ট্রাকচার ভালো না, ভয়েস ভালো না, হাঁটা ভালো না, পা কালো, চোখ মায়াবী না, মেয়েটার অনেক ডার্ক সার্কেল ইত্যাদি।

এখন, যে বা যারা এমন সব কাজ প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে তারা হয়তো জানেই না এটা একটা মেয়ে বা একটা নারীর জন্য কতোটা অপমানের বা কতোটা যন্ত্রণাদায়ক।

আজ আমরা যারা একটা মেয়ের বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে এতো বিশ্লেষণ করি তারা কি জানি একটা মেয়ে নিজেই তার পারফেক্ট না হওয়া নিয়ে কতটা কষ্ট পায়? সে কতোখানি মানসিক চাপ অনুভব করে?

হয়তো সেই মেয়েটা সর্বক্ষন চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে কিভাবে সর্বোচ্চ সুন্দরী বানানো যায়, নিজেকে কিভাবে সুন্দরী বান্ধবীরটার মতো সুন্দর করে তোলা যায় ইত্যাদি ভেবে। কারণ আমাদের সমাজ সুন্দর আর অসুন্দরের পার্থক্যটা খুব সুন্দর করেই তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।

কেউ কেউ বলে থাকেন-
“ভাবি মেয়েটার ওয়েট কমাতে বলেন। না হলে ভালো ছেলে পাবেন না। এখনকার ছেলেদের স্লিম মেয়ে পছন্দ।”

আবার কেউ কেউ বলেন-
“ভাবি আপনার মেয়ে যে চিকনা কোনো ছেলে পছন্দ করবে না।
ছেলেরা শুধু একটু হাইট চায়, আপনার মেয়ে তো অনেক খাটো।
-মেয়ে তো কালো, জামাইকে অনেক কিছু দেওয়া লাগবে বিয়ের সময়।
-মাথায় চুল কম কেন? আমার বৌমার মাথায় অনেক চুল।” হাজারো অসংগতি তুলে ধরা হয় একটা মেয়েকে ঘিরে।

এসব বলার জন্য বাসার আশেপাশের মানুষের অভাব নেই। কখনো অনুভব করা হয় না, যে কথাগুলো একটা মেয়ে বা তার পরিবারের মানুষগুলোর জন্য কতটা মানসিক অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে। যার প্রভাব পড়ে পরিবারের সকলের উপর।

আমাদের সমাজে একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে একটা সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আজ খুবই সাধারণ ব্যাপার। দুজন দুজনকে ভালোলাগার মাধ্যমে একটা সুন্দর সম্পর্কের শুরু হয়। তাদের কাছে প্রথম দিকে বাহ্যিক সৌন্দর্য কোনো বড় ব্যাপার মনে না হলেও কিছুদিন পর শুরু হয় নানান কথাবার্তা।

বলিউড, হলিউড, ঢালিউডসহ মডেল ও নায়িকাদের ছবি দিয়ে করা হয় নানান সব মন্তব্য, ” কি সুন্দর ফিগার, কি সুন্দর লাগছে এই ড্রেসে, এইটা আমার ক্রাশ, এর চুল সুন্দর, এর হাইট সুন্দর” ইত্যাদি।

প্রিয় বন্ধুর প্রতি কোন অভিযোগ না থাকলেও ঐ কথাগুলোই প্রিয় মানুষটিকে কষ্ট দেয়। ঐ কথা গুলো নারীকে ভাবায় যে, সে সুন্দর নয়।

নারীর মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়।
যেখানে প্রিয় মানুষের একটা সুন্দর কথা একজনকে অনেক বেশি আত্নবিশ্বাসী করে তুলতে পারে সেখানে আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত হয়ে আসছে বিপরীতটা।

পরিশেষে বলতে চাই, সময় এসেছে, কিছু কথা সকলকে সুন্দরভাবে ভাবতে হবে, কিছু বিষয়ে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে, তা হলো-
-হরমোনাল জটিলতার জন্য একটা মেয়ের ওজন বাড়তে বা কমতে পারে। -জেনেটিক্যালি একটা মেয়ে খাটো হতে পারে। -মাথা অতিরিক্ত ঘামলে একটা মেয়ের চুল পড়তে পারে। -রোদের কারণে মেয়েটা কালো হয়ে যেতে পারে। -নানান দুশ্চিন্তার কারণে ঘুম কম হলে একটা মেয়ের ডার্ক সার্কেল আসতে পারে, ইত্যাদি।

সময় বদলাচ্ছে, তাই আমাদেরও বদলাতে হবে৷ আমরা বদলালেই বদলাবে আমাদের পরিবার ও সমাজ।

একটা কথা আমাদের সবসময় চিন্তা করতে হবে যে, যেখানে সৃষ্টিকর্তা নিজে সকলকে বানিয়েছেন সেখানে আমরা কোনভাবেই তার সৃষ্টিকে অসুন্দর বলার যোগ্যতা রাখি না।

তাই সর্বোত্র একটাই চিন্তা বিরাজ করুক, তা হলো- “প্রতিটা মেয়েই সুন্দর কারণ প্রতিটা মেয়েই কারো মা হবে, আর মা সবসময়ই সুন্দর।”

Please follow and like us:

Check Also

বেড়িবাঁধ কেটে নোনাপানি ঢুকিয়ে ঘের ব্যবসা

সুন্দরবন–সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলায় যত্রতত্র বেড়িবাঁধ কেটে ও ছিদ্র করে পাইপ দিয়ে নোনাপানি উঠিয়ে চলছে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।