সংলাপ নিয়ে মনে হয় রাষ্ট্রপতিও হ্যাপি না

নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি আইন প্রণয়নের কথা জাতীয় সংসদকে বলতে পারেন। সেই সময় এখনো হাতে আছে।
সংলাপ নিয়ে মনে হয় রাষ্ট্রপতি নিজেও ‘হ্যাপি’ না। এ কারণে ইসি গঠনে আইন প্রণয়নেরই তাগিদ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।  সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের ভেতরে এখন চরম নিয়ন্ত্রণহীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
টাকাপয়সা ও অর্থবিত্তের মালিকরা দলের ভেতরে-বাইরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর বর্তমান সরকার উন্নয়নকে বেশি প্রাধান্য দিতে গিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকে অনেকাংশে ম্লান করে দিচ্ছে। তবে মহামারির মধ্যেও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, অর্থনীতির চাকা সচল রাখা, উন্নয়ন এবং অগ্রগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে বড় সাফল্য।

এছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্প, কমিউনিটি ক্লিনিক, টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণসহ অনেক কাজ সরকার ভালো করেছে। আবার করোনাকালীন স্বাস্থ্য খাতের কঙ্কালসার চেহারাটাও প্রকাশ পেয়েছে। এ খাতে এত অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, অব্যবস্থাপনা-তা জনগণকে হতাশ করেছে।

দীর্ঘ আলোচনায় রাশেদ খান মেনন নতুন ইসি গঠন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, চলমান রাজনৈতিক সংকট, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অবস্থা, সরকারের তিন বছরের সফলতা-ব্যর্থতাসহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন। সোমবার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন যুগান্তরের বিশেষ প্রতিনিধি শেখ মামুনুর রশীদ। এর চুম্বকীয় অংশ নিচে দেওয়া হলো-

রাশেদ খান মেনন এমপি বলেছেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে আমরা এর আগে দুই রাষ্ট্রপতির তিন দফায় সংলাপে অংশ নিলাম। আশা করিনি এবারও একই ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে বসতে হবে। ভেবেছিলাম সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা অনুযায়ী ইসি গঠনে আইন হবে, বিধিবিধান প্রণয়ন হবে। দুঃখজনক, হলো না। আইনটি হলে এই সংলাপের প্রয়োজন হতো না। প্রতি পাঁচ বছর পর সংলাপের নামে একই জিনিস চলতে পারে না। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই কথা বারবার বলতে ভালোও লাগে না। আমার তো মনে হয়, রাষ্ট্রপতি নিজেও ‘হ্যাপি’ না। বারবার একই বিষয় নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। তিনি নিজেও বলেছেন, এ নিয়ে বারবার কথা বলতে তার ভালো লাগে না। এ কারণে ইসি গঠনে আইন প্রণয়নেরই তাগিদ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।

তিনি আরও বলেন, সংলাপের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। এবারের সংলাপের পর রাষ্ট্রপতি কী করবেন, সেটি তার ওপর নির্ভর করবে। ফলাফল কী হবে, তাও বলা যাবে ইসি গঠনের পর, এর আগে নয়। তবে রাষ্ট্রপতি ইসি গঠনের জন্য আইন প্রণয়নের কথা জাতীয় সংসদকে বলতে পারেন। সেই সময় এখনো হাতে আছে। যেমনটা নব্বইয়ের পর দেশ রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থায় নাকি সংসদীয় গণতন্ত্রে ধাবিত হবে, তা ঠিক করতে জাতীয় সংসদকে বলেছিলেন তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। ইসি গঠনের বিষয়টি ভিন্ন প্রেক্ষাপট হলেও রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদকে বলতে পারেন, সেই ক্ষমতা তার আছে।

প্রবীণ এই বাম নেতা বলেন, রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজের প্রতিনিধিসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন আইন চায়। এমনকি ক্ষমতাসীনরাও আইনটি করবেন বলে বারবার আশ্বস্ত করেছেন। তবুও ইসি গঠনে আইনটি আর হলো না। অসুবিধাটা কোথায়, বাধাটা কোথায়-কেউ বলতেও পারছে না। সব মহলের দাবি সত্ত্বেও আইনটি যখন হলোই না, তখন আমরা বলছি সার্চ কমিটিতে যে নামগুলো জমা হবে, সেগুলো জাতীয় সংসদের কার্যউপদেষ্টা কমিটিতে পাঠাতে। কার্যউপদেষ্টা কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী আছেন। বিরোধীদলীয় নেতাও আছেন। জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও আছেন। সবাই এখানে বসে সার্চ কমিটির তালিকা থেকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং নির্বাচন কমিশনার (ইসি) কারা হবেন, তা ঠিক করবেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ দেবেন। এটি হলে অন্তত বিতর্ক অনেকটা কমবে। আর না হলে জন্মলগ্ন থেকে ইসি যে বিতর্কের মধ্য দিয়ে পথ চলছে, সেই বিতর্ক তাদের পিছ ছাড়বে না। রাজনৈতিক দল ও জনগণের কাছে তারা আবারও আস্থাহীনতার মুখে পড়বে। নতুন করে সংকটে পড়বে দেশ।

বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল সংলাপে যায়নি, বিষয়টি কীভাবে দেখছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি গতবার সংলাপে অংশ নিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে সংলাপকে অর্থহীন বলছে তারা। যে কারণে দলটি এবার সংলাপে অংশ নেয়নি। বিএনপি ইতোমধ্যে বলে দিয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। শেষ পর্যন্ত দলটি কী করবে, তা সময় বলে দেবে। গতবারও তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না নেবে না বলেও শেষ মুহূর্তে নির্বাচনি ট্রেনে উঠে পড়ে। যদিও তাদের সেই নির্বাচনি অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।

তাহলে কি অতীতের মতোই বাংলাদেশ আরেকটি নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে-এমন প্রশ্নে রাশেদ খান মেনন বলেন, এটা বলার সময় এখনো আসেনি। ইসি গঠনের পর রাজনৈতিক সংকট কোনদিকে মোড় নেয়, বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী করে, অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান কী হয়, সরকারি দলের ভূমিকা কী হয়-এগুলোর ওপর নির্ভর করছে আগামী নির্বাচন।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনেক স্থানেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টির এই নেতা বলেন, প্রথম দুই ধাপের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার ঘটনা বেশি ছিল। পরের দুই ধাপের নির্বাচনে দেখা গেছে, অধিকাংশ জায়গায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই পরাজিত হচ্ছেন। এমনকি কারও কারও জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। এটি অবশ্যই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য খারাপ সংকেত। যদিও আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে সর্বত্র আওয়ামী লীগের বিকল্প আওয়ামী লীগই। আমার মনে হয়, বিষয়টি এভাবে দেখলে হবে না।

রাশেদ খান মেনন বলেন, আওয়ামী লীগের ভেতরে এখন চরম নিয়ন্ত্রণহীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। টাকাপয়সা ও অর্থবিত্তের মালিকরা দলের ভেতরে-বাইরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা বুঝে গেছে পদ পেলেই টাকা করা যায়। তাই টাকা দিয়ে দলের পদ বাগিয়ে নিচ্ছে। মনোনয়ন বাগিয়ে নিচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, পদ নিতে টাকা, মনোনয়ন নিতে টাকা, নির্বাচনের সময় টাকা-সর্বত্র এখন টাকা আর টাকা। অভিযোগ রয়েছে-প্রায় ১ কোটি টাকা খরচ করে কেউ কেউ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন। জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন। এরা প্রধানমন্ত্রীকে মানছেন। কিন্তু এর বাইরে আর কাউকে মানছেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এদের কারণে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তাই এখনো সময় আছে, অর্থশালী-বিত্তশালী, যারা দল ও সংগঠন গিলে খাচ্ছে, তাদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। দলের ভেতরে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বর্তমান সরকারের তিন বছর পূর্ণ হলো। এ সময়ে সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা প্রসঙ্গে প্রবীণ এই বামপন্থি রাজনীতিক বলেন, করোনা মহামারির মধ্যেও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, অর্থনীতির চাকা সচল রাখা, উন্নয়ন এবং অগ্রগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া-বর্তমান সরকারের নিঃসন্দেহে বড় সাফল্য। এছাড়াও আশ্রয়ণ প্রকল্প, কমিউনিটি ক্লিনিক, টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণসহ অনেক কাজ সরকার ভালো করেছে। একই সঙ্গে আবার এই করোনাকালীন স্বাস্থ্য খাতের কঙ্কালসার চেহারাটাও প্রকাশ পেয়েছে। এই খাতে এত অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, অব্যবস্থাপনা জনগণকে হতাশ করেছে। করোনার এই সময়ে শিক্ষাব্যবস্থা তো ধ্বংসই হয়ে গেছে। সংবিধানে এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতাহারে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা হলেও কার্যত উলটো পথে হাঁটছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। একমুখীর পরিবর্তে বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তৃতি ঘটেছে দেশে, যা সত্যিই দুঃখজনক।

রাশেদ খান মেনন বলেন, বর্তমান সরকার উন্নয়নকে বেশি প্রাধান্য দিতে গিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকে অনেকাংশে ম্লান করে দিচ্ছে। উন্নয়ন দরকার, একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকাটাও দরকার। দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে এই উন্নয়নই একসময় নতুন সংকট তৈরি করবে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টি। এখন জোটের কর্মকাণ্ড এবং অবস্থান কী, আগামী নির্বাচনেও কি আপনারা জোটগতভাবে অংশ নেবেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মনে করি, জোটের রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা এখনো আছে। উপমহাদেশের সর্বত্রই এখন জোটের রাজনীতি, জোটগত নির্বাচনের সংস্কৃতি চলছে। বাংলাদেশও এর বাইরে না। যে যাই বলুক, এককভাবে নির্বাচন করে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব না, এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই বড় দলগুলো জোট করে। ১৪ দলীয় জোট যেহেতু একটি আদর্শিক জোট-রাজনৈতিকভাবে আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি একসঙ্গে নির্বাচনেও অংশ নিয়েছে এই জোট। আগামী দিনে এই জোট থাকবে কি থাকবে না, তা আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করছে। যদি আওয়ামী লীগ মনে করে তারা জোট ছাড়াই আগামী দিনে এককভাবে নির্বাচন করে সরকার গঠন করতে পারবে, তাহলে তারা জোটের পথে নাও হাঁটতে পারে। কী হবে-আমি মনে করি, তা আসলে ২০২২ সালেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। যুগান্তর

Check Also

উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ে তুলব: পরিদর্শন বইয়ে প্রধানমন্ত্রী

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে ঢাকার সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।