ইউক্রেন-রাশিয়ার দ্বন্দ্বে তুরস্কের কঠিন সমীকরণ

ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে টান টান উত্তেজনার মধ্যেই তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান কিয়েভ (ইউক্রেনের রাজধানী) সফর করলেন। সেখানে তিনি চলমান বিরোধ নিরসনে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যস্থতা করতে তার ইচ্ছা পুনঃব্যাক্ত করেন।

এর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকেও তুরস্কে দাওয়াত দিয়েছেন এরদোয়ান। এ মাসের শেষ দিকে পুতিনের  তুরস্ক সফর করার সম্ভাবনা আছে।

তুরস্ক এই অঞ্চলে নতুন কোন যুদ্ধ চায় না। যদিও গত কয়েকমাস ধরে আমেরিকা অভিযোগ করে আসছে যে, রাশিয়া যে কোনো সময়ে হামলা করবে ইউক্রেনে।

ওয়াশিংটন এখন আবার বলছে যে, রাশিয়া মিথ্যা অজুহাত তৈরি করে ইউক্রেনে হামলার পরিকল্পনা করছে।

ব্রিটেন আবার ইউক্রেনের কিছু ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করে অভিযোগ করেছে যে, তারা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদামির জেলেন্সকিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে রাশিয়ার গোয়েন্দাদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করছে। ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ১ লাখ সৈন্য মোতায়েন করে রাশিয়া বর্তমান অচলবস্থার সৃষ্টি করছে বলে দাবি করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

যদিও রাশিয়া বলছে, তার দেশের মধ্যে যেকোনো জায়গায়ই সেনা মোতায়েন করার অধিকার তার আছে। আবার রোমানিয়ায় এক হাজার এবং পোল্যান্ডে দুই হাজার অতিরিক্ত আমেরিকান সৈন্য পাঠিয়ে মার্কিন প্রশাসন পরিস্থিতি আরও জটিল করছে বলে দাবি করছে রাশিয়া।

পরিস্থিতি শান্ত করতে রাশিয়া এবং আমেরিকা একে অপরকে যে প্রস্তাব দিয়েছে, দুই পক্ষের কেউই সে প্রস্তাব মানতে নারাজ। সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুত নিচ্ছে উভয় পক্ষ। এ রকম একটা যুদ্ধে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ঐক্যবদ্ধ করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চাইছে আমেরিকা। কিন্তু ইউক্রেন নিয়ে ইউরোপ এখনো দ্বিধাবিভক্ত। এই পরিস্থিতি আমেরিকাকে ভালোই বেকায়দায় ফেলেছে।
কিছুদিন আগে জার্মানি আর ক্রোয়েশিয়া ইউক্রেনে ন্যাটো সৈন্য এবং অস্ত্র পাঠানোর বিপক্ষে অবস্থানের কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। এবার হাঙ্গেরিও বলেছে তারা ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমাদের পক্ষে থাকবে না।

এদিকে আবার ইউরোপের তৃতীয় হেভিওয়েট ফ্রান্সও আমেরিকা বা ন্যাটোর পক্ষে অবস্থান না নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ পুতিনের সঙ্গে দেখা করতে রাশিয়া যাবেন বলে জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট।

ফরাসি প্রেসিডেন্টের এই সফর প্রমাণ করবে যে, আমেরিকা রাশিয়াকে যেভাবে একঘরে করে ফেলতে চেয়েছিল সে প্রচেষ্টা কিছুটা হলেও ব্যর্থ হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তুরস্ক মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। তুরস্ক এই অঞ্চলে নতুন করে আর যুদ্ধ চায় না।

গত কয়েকবছর ধরে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে চরম বৈরী সম্পর্কের পরে এখন সে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। চির শত্রু আর্মেনিয়ার সঙ্গে অনেক বছর পরে সম্পর্ক গড়তে শুরু করেছে আঙ্কারা।

সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মিশর এবং ইসরাইলের সঙ্গে দ্রুত সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে হাঁটছে তুরস্ক। এ অবস্থায় নতুন একটা যুদ্ধ আবার সবাইকে কোন না কোন পক্ষা নিতে বাধ্য করবে। সেখানে আবার পরস্পর বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয়ার সম্ভবনা আছে এই দেশগুলোর। যেমনটি হয়েছে ইরাক, সিরিয়া এবং লিবিয়ায়। তাই তুরস্ক জোর চেষ্টা চালাচ্ছে ইউক্রেন আর রাশিয়ার মধ্যের দ্বন্দ্ব যেন টেবিলেই মিটমাট হয়ে যায়। এই অবস্থা যেন যুদ্ধের মাঠ পর্যন্ত না গড়ায়।কারণ যুদ্ধ বাঁধলে তুরস্ক পড়বে দোটানায়। না পারবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেতে না পারবে ইউক্রেন থেকে দূরে থাকতে।

এরদোয়ানের ইউক্রেন সফরে দু’দেশের মধ্যে ৮টি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যার মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং ইউক্রেনে তুরস্কের বাইরাক্তার ড্রোন উৎপাদনের চুক্তি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা দরকার। তুরস্কের এই ড্রোন সিরিয়ায়, লিবিয়ায় এবং আজারবাইজানে রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ট্যাংক এবং কামান ধ্বংস করে যুদ্ধের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছে। ইউক্রেনও কিনেছে তুরস্কের এই ড্রোন। সেগুলো পূর্বের সংঘাতপূর্ণ ডোনবাস এলাকায় মোতায়েন করেছে ইউক্রেন।

ইউক্রেনে পাঠানো তুরস্কের এই নিয়ে রাশিয়া ইতিমধ্যে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। এখন ইউক্রেনে নতুন করে এই ড্রোন উৎপাদনের চুক্তি রাশিয়া কিভাবে নিবে দেখার বিষয়। ওদিকে আমেরিকা এরদোয়ানের ইউক্রেন সফরে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে।

এরদোয়ানের এই সফর এবং চুক্তিগুলো নিঃসন্দেহে ইউক্রেনের প্রতি তুরস্কের সমর্থনের প্রমান বহন করে। তবে যুদ্ধ বাধলে তুরস্ক যদি সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তাহলে রাশিয়া তুরস্ককে ভিন্ন দিক দিয়ে চাপে ফেলতে চাইবে। যেমনটি আগে অনেকবার করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন।

সিরিয়ায় এবং লিবিয়ায় তুর্কি সেনাদের বা তুর্কি সমর্থিত বাহিনীর উপর হামলা করতে পারে রাশিয়া। আবার রুশ পর্যটকদের তুরস্কে সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে পর্যন্ত খাতে বড় অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করতে চাইবে। আর এগুলো তখন এরদোয়ানকে দেশের মধ্যে ভালোই চাপে ফেলবে। আবার ইউক্রেন ইস্যুতে আমেরিকার পাশে থাকলে আমেরিকার সঙ্গে তুরস্কের চলমান সংকটের কিছুটা অবসান হতে পারে। এছাড়াও ইউক্রেনের সঙ্গে তুরস্কের অনেকগুলো বড় বড় সামরিক চুক্তি আছে।

তুরস্কের সামরিক শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইঞ্জিন আনছে ইউক্রেন থকে। যুদ্ধ বাধলে সেগুলোও সংকটের মুখে পড়বে। এ কারণে তুরস্ক কিছুতেই একটা যুদ্ধ চাইছে না। আর যুদ্ধ যদি বেঁধেই যায় তাহলে সে অবস্থায় তুরস্কের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ কিন্তু প্রচণ্ডরকম কঠিন পথ হচ্ছে নিরপেক্ষ থাকা। অর্থাৎ উভয় পক্ষের সঙ্গে সমান সম্পর্ক এবং সমান দূরত্ব বজায় রাখা। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করলে তুরস্ক কি ক্রাইমিয়ান তাতার মুসলমানদের পাশে দাঁড়াবে? অতীত বলে ভিন্ন কথা। দেখা যাক ভবিষ্যতে কী হয়।

লেখক: সরোয়ার আলম

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক

Please follow and like us:

Check Also

ইসরায়েলের অনুরোধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক

ইরান থেকে ইসরাইলের উদ্দেশ্যে শতাধিক ড্রোন ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। এসব প্রতিহত করতে ইসরাইলের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।