সাতক্ষীরায় মৎস্য ঘেরে পরিবেশবান্ধব ধান ও সবজি চাষ মাইল ফলক হতে চলেছে

আবু সাইদ বিশ্বাস: মাছের ঘেরে ধান চাষে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলা সমূহে। শীত মৌসুমে ঘেরে পানি কমে যাওয়াতে মৎস্য চাষীরা বোরো ধান চাষে আগ্রহী হয়ে উঠে। চিংড়ি ঘেরে বোরো ধান ও সবজির সমনি¦ত চাষের মাধ্যমে প্রান্তিক চাষিরা পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে । কষ্টের জীবন বদলে অনেকের সংসারে সুদিন এনেছে মাছ ও ধান চাষে। জেলাতে গ্রামের পর গ্রামজুড়ে নিচু জমিতে গড়ে উঠেছে মাছের ঘের। বর্ষায় সেই ঘেরে মাছ বড় হয়। নভেম্বর-ডিসেম্বরে সেই মাছ ধরা হয়। শীতে হয় বোরো ধানের আবাদ। চাষিরা বলছে মাছের ঘেরে ধানের ফলন হয় অন্য জমির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। মাছ ও ধান প্রত্যন্ত এলাকাকে এখন সমৃদ্ধ জনপদে পরিণত করেছে। ধান গবেষকরা বলছে ধান গাছের অবশিষ্টাংশ এবং সবজির উচ্ছিষ্ঠাংশ পচনের ফলে জৈব পদার্থ এবং নাইট্রোজেন ও ফসফরাস জাতীয় যৌগ উৎপন্ন হয় যা ঘেরে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। মাছের খাবারের উচ্ছিষ্ঠাংশ ও মলমূত্র তলদেশে জমা হয়। তলদেশের জৈব উপাদান সমৃদ্ধ মাটি ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ধান ও সবজি চাষ করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কৃষিনির্ভর উপকূলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য উপখাতের পাশা পাশি বোরোর আবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভবনাময় হয়ে উঠেছে।
নিজেদের বুদ্ধি আর প্রকৃতির ঋতুবৈচিত্র্য কাজে লাগিয়েই এ সফলতা। ঘেরে বৈশাখ- জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে পাঁচ ছয় মাস চাষ করা হয়। মিষ্টি কুমড়া, জালি, ঢেঁড়স, শসা ক্ষিরা, লাউ ও পুঁইশাকে ভরে যায় ঘেরের আইল। দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও রপ্তানি আয়ে এখানকার মৎস্য খাতের অবদান আজ সর্বজনস্বীকৃত। মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৪.৭৩ শতাংশ মৎস্য উপখাতের অবদান এবং কৃষিজ জিডিপিতে ২৫.৭২ শতাংশ। দেশের প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশেরও বেশি অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই খাতের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
বাংলাদেশে ৩ দশমিক ৫ লাখ হেক্টর আয়তনের প্রায় ১৩ লাখ পুকুর-দিঘি রয়েছে। এ ছাড়া ও ১ দশমিক ১৪ লাখ হেক্টর জলায়তনের প্রায় ১১ হাজার বিল, ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর আয়তনের বাঁওড় এবং ২৮ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টরের বিশাল প্লাবনভূমিতে বোরো চাষ অফুরান্ত সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
সাতক্ষীরায় এবার শীতের তীব্রতা এবং শৈত্যপ্রবাহের পরিমাণ অন্য বছরের তুলনায় কম। তাছাড়া এ অঞ্চলে তীব্র শীতের আগমনও ঘটে দেরিতে। তাছাড়া কুয়াশার আধিক্যতা কম। যে কারণে বোরো ধানের চারা উৎপাদন ভালো হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূলে থাকায় চারা উৎপাদনে কৃষকের মুখে এখন নতুন স্বপ্নের এবং আনন্দের হাসি। জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। শতভাগ অর্জিত হবে বলে আশা করছেন কৃষকসহ কৃষি কর্মকর্তারা।
সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরার সাত উপজেলায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ২৪ হাজার ৫০০ হেক্টর, কলারোয়ায় ১৪ হাজার হেক্টর, তালায় ২০ হাজার হেক্টর, দেবহাটায় ৬ হাজার হেক্টর, কালীগঞ্জ উপজেলায় ৫ হাজার ৫০০ হেক্টর, আশাশুনিতে ৮ হাজার হেক্টর ও শ্যামনগরে ২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। যে খানে গত বছর আবাদ হয়ে ছিল ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে। জেলাতে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লক্ষ ৫১ হাজার ২শ মেট্রিক টন। কৃষি বিভাগের হিসাব মতে জেলাতে ৩ লক্ষ ৫৮ হাজার ৫৫০টি পরিবার কৃষি কাজ করে থাকে। সব মিলিয়ে কৃষির সাথে জড়িত রয়েছে ১৪ লক্ষ ৩৪ হাজার ২শ কৃষক। এসব কৃষকের মধ্যে বর্তমান বোরো চাষের সাথে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ জড়িত।
সাতক্ষীরা কৃষি বিভাগের উপপরিচালক নূরুল ইসলাম জেলাতে লক্ষ্য মাত্রা চেয়ে বেশি জমিতে বোরোর আবাদ হতে চলেছে। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও জেলার চাষিরা ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করে রের্কড সৃষ্টি করবে। এছাড়া দেশের প্রতিটি উপজেলায় জলবায়ুর ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করে কৃষি, খাদ্য ও অবকাঠামোসহ সবগুলো বিষয় নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার।বিশেষ করে মৎস্য ঘেরে বোরোর আবাদে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
তবে গবেষণার মাধ্যমে বৈরী জলবায়ুর সাথে অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তার স্বতঃস্ফূর্ত বাস্তবায়নে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা।

Check Also

আলিপুর ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন জিয়াউল ইসলাম জিয়া

নিজস্ব প্রতিনিধি: সাতক্ষীরার সদরের আলিপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।