৭ মার্চের ভাষণ: স্বাধীনতার প্রশ্নে কৌশলী হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স মাঠের জনসভায় স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে চাপ ছিল। এ বিষয়ে ব্যক্তি ও গ্রুপ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়েছিল। তবে জাতির পিতা সাড়া না দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রশ্নে কৌশলী হয়েছিলেন। ৭ মার্চ তিনি স্বাধীনতার  ঘোষণা করলেন ঠিকই কিন্তু সেটা করলেন বিচ্ছিন্নতাবাদের দায় এড়িয়ে। ভাষণে কৌশলে বাঙালির স্বাধীনতার ডাকই দিয়েছিলেন। আবার দেশ ভাঙ্গার অভিযোগের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগও দেননি পাকিস্তানি শাসককে।

সাত মার্চ সরাসরি কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি এই বিষয়ে পরবর্তী সময়ে জাতির বঙ্গবন্ধু নিজেই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ৭ মার্চের ওই ঘটনা বর্ণনা করেন বঙ্গবন্ধু। ফ্রস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জানতে চান, ‘আপনার কি ইচ্ছা ছিল যে, তখন ৭ মার্চ রেসকোর্সে আপনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেবেন?’ জবাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি জানতাম এর পরিণতি কী হবে এবং সভায় আমি ঘোষণা করি যে এবারের সংগ্রাম মুক্তির, শৃঙ্খল মোচন এবং স্বাধীনতার।’ ফ্রস্ট প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যদি বলতেন, আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি, তো কী ঘটত?’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তর দেন, ‘বিশেষ করে ওই দিনটিতে আমি এটা করতে চাইনি। কেননা, বিশ্বকে তাদের আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আঘাত হানা ছাড়া আমাদের আর কোনও বিকল্প ছিল না। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।

সাত মার্চ ভাষণের আগে দলের একাধিক নেতা বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য প্রভাবিত করেছিলেন এমনটি উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ এক মতামত কলামে লিখেছেন, একজন নেতা বঙ্গবন্ধুকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, আজকে কিন্তু পরিপূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণা ছাড়া মানুষ মানবে না। জবাবে বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম দি লিডার অব দি পিপল। আই উইল লিড দেম। দে উইল নট লিড মি। গো অ্যান্ড ডু ইউর ডিউটি।

তবে তাদের কথা না শুনে শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন উল্লেখ করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর এমন বিচক্ষণতা ও চাতুর্যের সঙ্গে বললেন—একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তিনি পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি। তার এই সতর্ক কৌশলের কারণেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি। এই একটি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে একই মোহনায় দাঁড় করিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ঠিকই কিন্তু তা বিচ্ছিন্নতাবাদের দায় এড়িয়ে। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতাটাকে এমনভাবে সাজালেন যে একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণাও হলো, অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িতও হতে হলো না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শেখ মুজিবকে ‘চতুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলো, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।

কলামিস্ট মরহুম সৈয়দ আবুল মকসুদ ২০১৭ সালে একটি কলামে লিখেছেন, ওই সময় আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতাকেও বলতে শোনা গেছে, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না কেন? কিন্তু তিনি তা করলে তা হতো বাঙালির জন্য চরম আত্মঘাতী। তাঁকে আখ্যায়িত করা হতো বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে। তিনি জনগণনন্দিত গণতান্ত্রিক নেতা থাকতেন না। বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার অর্জনের পথ খোলা রাখেন। যার কারণে ৭ মার্চের পরও তিনি ইয়াহিয়া, ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ তার ‘বাংলাদেশ রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন: ১৭৫৭-২০১৮’ বইয়ে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একজন দক্ষ কৌশলীর সুনিপুণ বক্তব্য। ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি (বঙ্গবন্ধু) ‘স্বাধীনতার’ কথা এমনভাবে উচ্চারণ করেন, যাতে ঘোষণার কিছু বাকিও থাকল না, আবার তাঁর বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগ উত্থাপন করাও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জন্য সম্ভব ছিল না। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতারই ঘোষণা। তবে সরাসরি তা ঘোষণা না করে তিনি কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর অবস্থান ছিল: মেজরিটি বা সংখ্যাগরিষ্ঠ (বাঙালি) মাইনরিটি বা সংখ্যালঘিষ্ঠ (পশ্চিম পাকিস্তানি) থেকে বিচ্ছিন্ন হবে কেন? বরং মাইনরিটিই ‘সিসিড’ বা বিচ্ছিন্ন হোক।

সাত মার্চ উপলক্ষে ২০২১ সালে সরকারের প্রকাশিত ক্রোড়পত্রে লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহিদ বীরপ্রতীক লিখেছেন, তার (বঙ্গবন্ধুর) ছিল কল্পনা শক্তি, প্রেরণা শক্তি আর অসাধারণ উপস্থিত বুদ্ধি। তিনি তার বক্তৃতায় প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা না করেও অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। সেদিন তার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল—হয় সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা অথবা পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব না কাঁধে না নিয়ে, বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত না হয়ে সুচিন্তিত বক্তব্য প্রদান করা। পাকিস্তানি সামরিক সরকার তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করার পথ খুঁজছিল। কিন্তু এই বিষয়ে তিনি সতর্ক ছিলেন বলে তাদেরকে এমন কোনও সুযোগই দেননি।

২০১৭ সালে আওয়ামী লীগের একটি সেমিনারে দলীয় প্রধান ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কেন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি তার কারণ ব্যাখ্যা করেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে ঘোষণা দিতে যারা তাগিদ দিচ্ছিলেন তাদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আক্রমণকারী কারা হবে? যারা আক্রমণকারী হবে, আন্তর্জাতিকভাবে তারাই হবে অপরাধী। আর কোনোমতেই বিচ্ছিন্নতাবাদী হওয়া যাবে না। তা হলে কখনও কোনো উদ্দেশ্য সফল হয় না।

সাত মার্চ জনসভার পর ৩২ ধানমন্ডির ঘটনার স্মৃতি চারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, কয়েকজন ছাত্রনেতাসহ বেশ কিছু নেতাকে বেশ উত্তেজিত দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু কেন স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি সেই প্রশ্ন তোলেন। বক্তব্যে সব মানুষ হতাশ হয়ে ফিরে গেছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। ঠিক এই কথাটা যখন বলছে, তখনই আমি ভেতরে ঢুকেছি। আমি একটু মুখের ওপর কথা বলে দেই; এটা আমার অভ্যাস। ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম, আপনারা এই রকম মিথ্যা কথা বলেন কেন? মানুষ কোথায় হতাশ হয়ে গেছে? তাহলে আপনারা মানুষ দেখেন নাই। আমি কিন্তু মানুষ দেখতে দেখতে আসলাম। মানুষের ভেতরে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা আমি দেখলাম, তাতে আমি তো কারো মুখে কোনো হতাশা দেখলাম না। আপনারা কেন আব্বাকে এ রকম মিথ্যা কথা বলেন। আব্বাকে এ রকম মিথ্যা কথা বলবেন না।

সেদিন যাদের তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে চাপাচাপি করতে দেখেছিলেন, পিতা বঙ্গবন্ধুকে তাদের কথায় কান না দিতে বলেছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি আব্বাকে সোজা বললাম, আব্বা আপনি ওদের কথা বিশ্বাস করবেন না। কারণ সবাই মিথ্যা কথা বলছে। মানুষ কিন্তু সাংঘাতিক উজ্জীবিত হয়ে যাচ্ছে। সবাই স্লোগান দিতে দিতে হলে ফিরে যাচ্ছে।

শেখ হাসিনা বলেন, সেদিন যাঁদের তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কথা বলতে দেখেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ পরে আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গেছেন। কেউ কেউ গিয়ে আবার ফিরেও এসেছেন। তিনি বলেন, এ রকমও কেউ ছিল— অনেকে চলে গিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র থেকে অনেক কিছু করতে চেষ্টা করেছেন। আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি, তারা ওই কথাটা তখন কেন বলেছিল? এটাও একটু চিন্তা ও বিশ্লেষণের দরকার আছে। কারণ আমি তো অনেক কিছুর সাক্ষী ওই বাড়িতে থেকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইল লেখক ও রাজনৈতিক গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ৭ মার্চের বক্তব্যে স্বাধীনতার ঘোষণার কথা ছিলো না। বঙ্গবন্ধু সেটা দিতে চাননি। বঙ্গবন্ধু তখনও নেগোশিয়েশন চেয়েছিলেন। এজন্য চারটি শর্ত দিয়েছিলেন। তবে, ঘোষণা দেননি এর মানে এই নয় যে তিনি স্বাধীনতা চাননি। এটা ছিলো একটা কৌশল।

এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার দায় নিতে হবে এটা একটা বিষয় তো ছিলই। বঙ্গবন্ধু নিজেও পরে বলেছেন—আমরা মেজরিটি, আমরা আলাদা হওয়ার জন্য বলবো কেন? মেজরিটি পার্টির নেতা হয়ে তিনি কেন আগ বাড়িয়ে ডিকলারেশন দেবেন। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে এটা সবাই টের পেয়েছিলেন কিন্তু কেউ এটার দায় নিতে চাননি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।