ইভিএম পরীক্ষা করে দেখলেন দেশসেরা প্রযুক্তিবিদরা, যা বললেন জাফর ইকবাল

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ হলে কারচুপি করার সুযোগ রয়েছে- বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলো ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অভিযোগের মুখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) দেশসেরা প্রযুক্তিবিদদের ডেকে নিয়ে যন্ত্রটি দেখিয়েছে।

ইসির ডাকে সাড়া দিয়ে বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে যান বুয়েটসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ ও শিক্ষকরা। তারা সেখানে গিয়ে ইভিএম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখেন। এমনকি এর গঠন পদ্ধতি, বিভিন্ন সার্কিট তারা খুলেও দেখেন।

পরীক্ষা করে দেখে প্রযুক্তিবিদরা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এটি (ইভিএম) পারফেক্ট ও নির্ভযোগ্য মেশিন।’ একইসঙ্গে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ইভিএম ব্যবহার করার আহ্বান জানিয়েছেন।

এর আগে সকাল সোয়া ১০টা থেকে প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয় ইসি এবং প্রযুক্তিবিদ-শিক্ষকদের মধ্যে। সভায় ছিলেন- প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল, চার নির্বাচন কমিশনার এবং শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম কায়কোবাদ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মতিন সাদ আবদুল্লাহ, ড. মো. মাহফুজুল ইসলাম, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) পরিচালক মেজর জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিন, সেনা কল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামসহ ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

সভা শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। কী দেখলেন, পরীক্ষায় কী পেলেন- সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি।  জাফর ইকবাল বলেন, ‘গতবার যখন (সংলাপে) এসেছিলাম, একজন বলেছিলেন- ইভিএম হাইটেক মেশিন। আমি বলেছিলাম, মোটেই হাইটেক নয়। এটা আমাদের ছাত্ররা বানিয়ে বিভিন্ন দেশে পুরস্কারও পেয়েছে। তাই মেশিনটা কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের সামনে উপস্থাপনের জন্য বলেছিলাম। ইসি সেই অনুরোধটি রেখেছে। সেজন্য তাদের ধন্যবাদ।’

জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমরা বৈঠকে ডেমোনেস্ট্রেশন দেখেছি পুরোটা। ভেতরের খুঁটিনাটিও জেনে নিয়েছি ওনারদের কাছ থেকে। আর একটা মেশিন ওনারা আমাদের জন্য খুলে রেখেছেন, যাতে আইসি লেবেল পর্যন্ত দেখতে পারি। এগুলো কীভাবে মাউন্ট করা হয়েছে। কেউ যদি এগুলো ম্যানিপুলেট করতে চায়, সেটা কতটা কঠিন হবে, সোজা হবে সে ধারণা করার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে কনভিন্সড হয়েছি যে, অত্যন্ত চমৎকার একটি মেশিন।’

‘মানুষজন সব সময় উদাহরণ দেয়, পৃথিবীর অমুক দেশ পারে নাই, অমুক দেশ পারে নাই, আমরা কেন করতে যাচ্ছি? আমি মোটেই সেভাবে দেখি না। আমি মনে করি আমাদের বাংলাদেশ, এইসব ব্যাপারে অনেক এগিয়ে আছে। ইনফ্যাক্ট আমাদের বায়োমেট্রিক ডাটাবেজ যেটা আছে, যেটাকে এনআইডি বলে থাকেন, আমার মনে হয় পৃথিবীর খুব কম দেশেই এই মূল্যবান জিনিসটা আছে। এটা থাকার জন্য আমরা অনেক কিছু করতে পারি, যেটা অনেক দেশ করতে পারে না। নিজের দেশের ওপর কনফিডেন্সটা রাখতে হবে। যেহেতু আমাদের বায়োমেট্রিক ডাটা আছে।’

জাফর ইকবাল বলেন, ‘এখানে ভোটিংটা অনেক নিখুঁতভাবে করা সম্ভব। একজন মানুষ অন্য মানুষের ভোট দেওয়ার বিষয়টা মোটামুটিভাবে অসম্ভব। কাজেই যারা এটা তৈরি করেছেন, আমি তাদের অভিনন্দন এবং আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই।’

‘মেশিনটা মোটামুটি পারফেক্ট একটা মেশিন। আমাদের দেশের জন্য এটা অত্যন্ত সহজভাবে চালানো সম্ভব। খবরের কাগজে দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলো নতুন কমিশন তৈরিসহ তিনটা দাবির কথা জানিয়েছে। আমি রাজনৈতিক দলগুলোকে বলব, আপনারা যদি নতুন কমিশন তৈরি করতে পারেন, তখনো এই ইভিএম মেশিনটা ব্যবহার করবেন। আপনাদেরই লাভ হবে।’

এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে ধরেন যখন স্পেসশিপ পাঠানো হয়েছিল, ট্রিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট, সেটাও ভেঙে পড়েছিল। কাজেই কোনো যন্ত্র যদি হয়, সেখানে আপনি কখনোই বলবেন না, বলা উচিত না, শতভাগ সফল হবে। কিন্তু আমরা বলতে পারি যে, এটা প্রসেসে যদি সমস্যা হয়, ঠিক করার ব্যবস্থা আছে কি না। আমাকে যদি বলা হয়, একটা যন্ত্র তৈরি করে দাও, যন্ত্র যদি ম্যালফাংশন করে, সেটা ঠিক করার ব্যবস্থা করে দাও, তাহলে আমি রাজি আছি। এখানেও তাই আছে। বিভিন্ন ধরনের ডেটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে।’

দেশের এই প্রযুক্তিবিদ আরও বলেন, ‘ম্যানিপুলেশন করার এখানে কোনো জায়গা নেই। ম্যানিপুলেশন করার জন্য যে লেভেলে যাওয়ার দরকার, সেই লেভেলে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব না। অপারেট করার শুরুতে এটা দেখানোর ব্যবস্থা আছে, যেখানে কী আছে, না আছে। এখন বিশ্বাস করবেন কি করবেন না, সেটা আপনাদের বিষয়।’

বিএনপিসহ দেশের অনেক রাজনৈতিক দলের অভিযোগ ইভিএমে এক প্রতীকে ভোট দিলে চলে যায় অন্য প্রতীকে- এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে জাফর ইকবাল বলেন, ‘এক মার্কার (প্রতীক) ভোট এক প্রার্থীর মার্কায় গিয়ে পড়বে, এটা এই মেশিন দ্বারা করা সম্ভব না। আমি সার্কিটগুলো খুলে দেখানোর জন্য বলেছিলাম। এটা ম্যালফাংশন করতেই পারে, ম্যালফাংশন করলে সেটা পরবর্তীতে অন্য মেশিন ব্যবহার করা যায়, কিন্তু ম্যানপুলেট করার কোনো সুযোগ নেই।’

এ সময় সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে এই প্রযুক্তিবিদ বলেন, ‘ভোট দেওয়ার পর পেপার কেটে কেটে রাখার আইডিয়াটা আদিম আইডিয়া। এটা মেশিনেই থাকে, এটা নতুন করে করার দরকার নাই। এটা আরেকটা বিড়ম্বনা সৃষ্টি করবে। কারণ রাতের বেলা পেপার কেটে কেটে অনেকে ভেতরে রাখতে পারেন, এতে আরও বিড়ম্বনা হবে। ভারত করেছে তাই আমাদের করতে হবে, এই ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমি সেটা বিশ্বাস করি, আমার দেশের প্রযুক্তিবিদ যারা আছেন, তারা অন্য অনেক দেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে।’

আঙুলের ছাপ না মিললে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার আঙুলের ছাপ ব্যবহার করার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে, যাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেই বা মেলে না। হাত কাটা পড়েছে, সেই ধরনের মানুষের জন্য একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর বেশি কিছু না। আমি যেহেতু টেকনোলজির মানুষ আমি বলব, এই জিনিসটা (ইভিএম) অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।’

ইসির সঙ্গে সভায় অংশ নেওয়া অধ্যাপক এম কায়কোবাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘কোনো মেশিনকে শতভাগ বিশ্বাস করা যাবে না। তবে এখানে যেটা করা হয়েছে (ইভিএম), ম্যানিপুলেশনের কোনো সুযোগ নেই। প্রত্যেকটা বিষয় এমনভাবে কাস্টমাইজ করা হয়েছে, কেউ ইচ্ছা করলেই সেটা ম্যানিপুলেট করা সম্ভব না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা একটি স্মার্ট দেশ। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট দক্ষ। তাদের আমরা বিশ্বাস করতে পারি। এই প্রকল্পে যারা ছিলেন, তাদের যে কমিটমেন্ট তাতে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, এটা খুব ভালো মেশিন তৈরি করা হয়েছে। আমি আশা করি, এটার ডিসপ্লে করা হবে, সেটা টেস্ট করতে পারবে যে কোনো নাগরিক। তারা এসে দেখতে পারবে যে, এখানে সবকিছু ঠিকভাবে হচ্ছে কি না।’

‘আমরা পরামর্শ দিয়েছি, এই মেশিন থেকে শুধু ভোট দেওয়া নয়, ভোটের যত স্ট্যাটিস্টিকস আছে, সব ধরনের ব্যবস্থা রাখতে। আশা করি, এগুলো ওনারা পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে করবেন।’

Please follow and like us:

Check Also

নতুন যোগ হচ্ছে ২০ লাখ দরিদ্র

মূল্যস্ফীতির কশাঘাত মোকাবিলায় ২০ লাখ ২৬ হাজার দরিদ্র মানুষকে নতুন করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।