এবারের বাজেটে সাতক্ষীরার উপকূল রক্ষায় পযাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নেই

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে উপকূল রক্ষায় পযাপ্ত অর্থ বরাদ্দের প্রতিফলন ঘটেনি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে উপকূল রক্ষা, নদী-জলাশয়, বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, গবেষণা এবং পরিবেশ সুরক্ষায় নজরদারির মতো বিষয়ে বাজেটে তেমন বরাদ্দ রাখা হয়নি। পরিবেশ খাতের প্রস্তাবিত বাজেট বরাবরের মতোই চমকহীন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত মোট বাজেট বরাদ্দ ১ হাজার ৫শ’ ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন খাতে ১ শ’ ৮৬ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।ফলে উপকূলের স্বার্থ রক্ষায় এবারের বাজেটে আলাদা বরাদবদ রাখা হয়নি। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ যা রাখা হয়েছে তার বাস্তবায়নকে চ্যালেঞ্জ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগ কবলিত দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলকে দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করে ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছিলেন জনপ্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের নেতারা। তারা উপকূলের টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সুপেয় পানি সরবরাহে সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় নতুন প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করে ছিল । কিন্তু এবারের বাজেটে সে সব সুপারিশের বেশির ভাগই আলোর মুখ দেখিনি। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের বাইরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বাজেটে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের আবাসন, জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি ও গবেষণা, সুনীল অর্থনীতির উন্নয়ন ও পরিবেশ বান্ধব বস্ত্র ও চামড়া শিল্পে সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
জলবায়ুু পরিবর্তন ও দুর্যোগকে মাথায় রেখে উপকূলে স্থায়ী ও মজবুত বেড়ি বাঁধ পুননির্মান, জনসংখ্যার অনুপাতে পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারসহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, উপকূলীয় মানুষের সুপেয় পানির টেকসই ও স্থায়ী সমাধান, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আদলে উপকূলে ‘একটি বাড়ি একটি শেল্টার’ নির্মাণ, নদী ভাঙন ও ভূমিক্ষয় ঠেকাতে উপকূলে ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা এবং সুন্দরবনসহ আশপাশের এলাকাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার মতো পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ এবারের বাজেটে স্থান পাইনি।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ হাজার ৫শ’ ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। উন্নয়ন খাতে রাখা হয়েছে ৭শ’ ৩৮ কোটি ৬৯ লাখ। যা মোট বরাদ্দের ৪৯ দশমিক ২০ শতাংশ। যা গত অর্থবছরের সংশোধিত উন্নয়ন বাজেট থেকে ১শ’ ৩৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা বেশি। ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে যথাক্রমে ৫৬ শতাংশ ও ৫৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লির্ডাসের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল জানান,জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগকে মাথায় রেখে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটসহ উপকূলীয় অঞ্চলে স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। ওই এলাকায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারসহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উপকূলবাসীর সুপেয় পানির টেকসই ও স্থায়ী সমাধান করতে হবে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আদলে উপকূলীয় এলাকায় একটি বাড়ি একটি শেল্টার কার্যক্রম শুরু করতে হবে। নদী-ভাঙন ও ভূমি-ক্ষয় ঠেকাতে উপকূলে ব্যাপকহারে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ ও সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। উপকূলের রক্ষাকবচ সুন্দরবন রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি উপকূল উন্নয়ন বোর্ড গঠন করতে হবে। এসব দাবি গুলো এবারের বাজেটে যথেষ্ট গুুরুত্ব পাইনি। ফলে উপকূল বাসীর উন্নয়ন অধরেই থেকে যাচ্ছে।
ভৌগলিক অবস্থান, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভঙ্গুর অবকাঠামো, দরিদ্রতা, দীর্ঘমেয়াদী লবণাক্ততা, সংকটাপন্ন কৃষি ইত্যাদি কারণে উপকূলীয় এলাকার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলা। তাই ওই এলাকাকে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করে দীর্ঘমেয়াদী মহাপরিকল্পনা নেওয়া দরকার। কারণ করোনা পরিস্থিতি এবং সুপার সাইক্লোন আম্পান ও ইয়াসের পর এখনো জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। বরং স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লবিত হচ্ছে। তাই নতুন করে ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’র খবরে ওই অঞ্চলের মানুষ চরম আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
লিডার্সের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাতক্ষীরা ও খুলনার উপকূলীয় এলাকায় প্রতিবছর পরিবার প্রতি গড়ে এক লাখ দুই হাজার ৪৮৯ টাকার ক্ষতি হয়। এরমধ্যে একটি পরিবারে সর্বোচ্চ ৫০ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৪৫ হাজার ২০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে।আরও বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ১৯৯১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ১৯৭টি বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে। যা এদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, সম্পদ, খাদ্য, পানি, বাসস্থানসহ অন্যান্য সংকট তৈরি করেছে। এ সংকট দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। এই সংকট থেকে উত্তরণে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়বে।তাই উপকূলের জীবন-জীবিকা সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।