ছয় খাতে বিপ্লব ঘটাবে পদ্মা সেতু: সুফল পেতে প্রয়োজন পদ্মা প্লাস পলিসি

‘পদ্মা সেতু হওয়ায় ৬ খাতে বিপ্লব ঘটবে। এগুলো হলো- সংযোগ স্থাপন, ব্যবসা-আঞ্চলিক বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প, পর্যটন এবং সামাজিক খাত। তবে এসব সফলতা এমনি এমনিই আসবে না। যেমনটি আসেনি যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতুর ক্ষেত্রে। পদ্মা সেতু থেকে সুফল পেতে পদ্মা প্লাস পলিসি তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং ব্যবসার খরচ কমাতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন।’

বৃহস্পতিবার পদ্মা সেতু ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। রাজধানীর কাওরান বাজারে নিজস্ব কার্যালয়ে এ সভার আয়োজন করে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যাটস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পদ্মা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষের প্যানেল অব এক্সপার্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এম শামীম জেড বসুনিয়া।

সংস্থাটির সাবেক সভাপতি হুমায়ুন কবীরের সঞ্চালনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন আইসিএবির সভাপতি শাহাদৎ হোসেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাব্বির আহমেদ। বক্তব্য দেন, সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাসিস বোস, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ, পিআরইর গবেষণা পরিচালক ড. এমএ রাজ্জাক, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ, সাংবাদিক শওকত হোসেন মাসুম, সাজ্জাদুর রহমান, আবু হেনা মুহিব প্রমুখ।

মূল প্রবন্ধে বলা হয়, পদ্মা সেতু হলে আগামী ৫ বছরে ১০ লাখ এবং ১০ বছরে ওই সব জেলায় ৩০-৪০ লাখ নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। শুধু বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলায় আগামী ১০ বছরে ৫০০-১০০০ নতুন কারখানা স্থাপন হবে। ফলে ১০ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা যোগ হবে দেশের অর্থনীতিতে। এই সেতু চালু হওয়ার পর ভারত ও নেপাল থেকে পর্যটক সংখ্যা বাড়বে। পর্যটন শিল্পে বিপ্লব ঘটবে। সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য কমবে ১.০১ শতাংশ। জাতীয়ভাবে দারিদ্র্য কমবে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সহজলভ্য হওয়ায় ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরের ওপর চাপ কমবে। বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে প্রবন্ধে বলা হয়, ৩ কোটি মানুষ পদ্মা সেতুর কারণে সরাসরি উপকৃত হবে। কৃষি পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত হবে। কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ কমবে। কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশ ঘটবে। এ সেতু হওয়ায় ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মনিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে পশ্চিমবাংলার যোগাযোগ অনেক সহজ হবে। ফলে তারা এই সেতুকে অর্থনৈতিক করিডোর হিসাবে ব্যবহার করায় বৈদেশিক মুদ্রায় আয় হবে। সেতুটির ফলে সরাসরি সড়ক ও রেলসংযোগ স্থাপিত হবে। ফলে মোংলা, পায়রা, এশিয়ান হাইওয়ে, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কসহ ভারতের ৭টি প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যাতায়াতের সময় ও দূরত্ব কমে আসবে।

প্রবন্ধে আরও বলা হয়, এডিবির মতে আগামী ৩১ বছরে যোগাযোগ খাতে পদ্মা সেতু থেকে আয় হবে ১৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, যা নির্মাণ খরচের ৫ দশমিক ৫ গুণ। এ ছাড়া সামাজিক অগ্রগতি অর্থনীতিতে যোগ করবে ২৫ বিলিয়ন ডলার। দুই পাড়ে নদী শাসনের মাধ্যমে যে জমি রক্ষা হয়েছে তার মূল্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সেতুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ গ্যাস এবং ইন্টারনেট লাইন গিয়ে সাশ্রয় করবে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ফেরি চলাচল না হওয়ায় খরচ সাশ্রয় হবে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. এম শামীম জেড বসুনিয়া বলেন, এই সেতুর মূল চ্যালেঞ্জ ছিল নিজস্ব অর্থায়ন। সেটি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সমাধান হয়। যা ছিল যুগান্তকারী একটি সিদ্ধান্ত। এছাড়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম খরস্রোতা এই নদীতে ব্রিজ নির্মাণের কারিগরি চ্যালেঞ্জও ছিল। এছাড়া ব্রিজ ব্যবস্থাপনার একটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে সেটি হলো অর্থনৈতিক কার্যক্রম না হলে শুধু যোগাযোগ বাড়িয়ে লাভ নেই। এজন্য পরিকল্পনা করতে হবে। যে টাকা এই সেতুতে খরচ হয়েছে তা আগামী ৩০ বছরে সুদসহ অর্থ মন্ত্রণালয়কে ফেরত দেওয়া যাবে। সেতুটি নির্মাণে সর্বোচ্চ সতর্কতা, মান এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়েছে। যে টাকা ব্যয় হয়েছে সেটি লাগাটাই স্বাভাবিক ছিল।

শাহাদৎ হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এটি বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীক। একজন সফল নেতাই পারেন মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে এবং তা পূরণ করতে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এই সেতু ব্যাপক পরিবর্তন আনবে।

ড. জামাল উদ্দিন বলেন, হার্ট অ্যাটাক হলে ব্লক সারাতে হয়। পদ্মা সেতু না থাকায় ওই অঞ্চল ছিল দেশের হার্টে ব্লকের মতো। পদ্মা সেতু হওয়ায় সেই ব্লক সারানো হয়েছে। ফলে সারা দেশে রক্ত সঞ্চালন সমান হবে।

ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, এই সেতু আঞ্চলিক বৈষম্য কমাবে। বৈষম্য দূর হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে। সেই সুফল পাবে ওই অঞ্চলের মানুষসহ সারা দেশ। তবে এজন্য একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা দরকার। যার মাধ্যমে পদ্মা সেতুর সুফল ঘরে তোলা যায়।

ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, যমুনা সেতু নির্মাণ হলেও দেশের উত্তরাঞ্চলে সেভাবে প্রভাব পড়েনি। তেমন কোনো শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি। কারণ শুধু সেতু করেই সব শেষ করা হয়েছিল। কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করা হয়নি। তবে পদ্মা সেতুর অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে একটি পদ্মা প্লাস পরিকল্পনা দরকার। সেই সঙ্গে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস কমাতে হবে। যাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়। কারণ বিনিয়োগ না হলে শুধু সেতু করে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।