যশোরে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি : টিআরএম চালু ও সেচ প্রকল্প বাতিলসহ পাঁচ দফা দাবি

বিলাল মাহিনী, যশোর :

পাঁচ দফা দাবিতে যশোর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছে যশোরের ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি। ২৬ জুন রবিবার জেলা প্রশাসকের পক্ষে স্মারকলিপি গ্রহণ করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রফিকুল হাসান।

দাবিগুলো হলো এরমধ্যে ৩ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার সেচ প্রকল্প ও প্রস্তাবিত প্রায় ৪৫ কোটি টাকার সেচ প্রকল্প বাতিল, ডেল্টা প্লান-২১০০ এর সুপারিশ বাস্তবায়ন ও ক্রাস প্রোগ্রামে বিল কপালিয়ায় টিআরএম চালু, আমডাঙ্গা খাল সংস্কার কাজ দ্রুত প্রি-ওয়ার্ক ও পোস্ট ওয়ার্ক জনসমক্ষে টাঙিয়ে দিতে হবে। কাজের স্বচ্ছতা নিরূপণে আন্দোলনকারী সংগঠন ও জনপ্রতিনিধি ও সেনাবাহিনীকে সংশ্লিষ্ট করে তদারকি কমিটি গঠন করতে হবে। খালের গেট ওঠানামা বন্ধ করার সাথে জড়িত পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জনপদের ফসল, বাড়িঘরসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, কৃষি ঋণ মওকুফ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এবং সরকারকে মিথ্যা তথ্য প্রদান, নদী হত্যা, জনপদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা, ফসল, বসতবাড়ি ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতির সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

স্মারকলিপি দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ, আহ্বায়ক রনজিৎ বাওয়ালি, জিল্লুর রহমান ভিটু, অধ্যক্ষ চৈতন্য কুমার পাল, শিবপদ বিশ্বাস, শেখর বিশ্বাস, রাজু আহমেদ, অধ্যাপক অনিল বিশ্বাস, জুয়েল মোল্ল্যা, হাসিনুর রহমান।

সংগঠনের আহবায়ক রনজিত বাওয়ালির স্বাক্ষরিত স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে ভবদহ জনপদের ২০০ গ্রামের প্রায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১০ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে পানিতে তলিয়ে যেতে বসেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্টরা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে প্রতি বছর জনগণকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা লুটের স্থায়ী ব্যবস্থা করে নিয়েছে। তাদের কাছে ভবদহ হলো- ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ‘নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে’। এই চক্র এতই ক্ষমতাবান যে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর ধৃষ্টতা দেখিয়ে ভবদহ স্লুইচ গেট থেকে মোহনা পর্যন্ত ৫০/৬০ কিলোমিটার নদী ভরাট করে ফেলেছে। পানি বেরোবার পথ রুদ্ধ। এই পরিণতির কথা বারবার বলা সত্ত্বেও পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় তাতে কর্ণপাত না করে জনপদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকার আয়োজিত এক কনভেনশনে নীতিগতভাবে পর্যায়ক্রমের বিলগুলোতে টিআরএম প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০২ সালে বিল কেদারিয়ায় এবং পরবর্তী বিল হিসাবে ২০০৬ সালে বিল খুকশিয়ায় টিআরএম এর সফলতায় স্রোতের ভরবেগ বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্রুত নদীগর্ভের পলি কেটে কাট পয়েন্ট থেকে নদী ২৫/৩০ ফুট গভীর ও মোহনা সচল হয়েছিল। পরবর্তী নির্ধারিত বিল কপালিয়ায় টিআরএম কার্যকর করতে গেলে প্রকাশ্য দিবালোকে সশস্ত্র আক্রমণে ২০১২ সালে হুইপ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা আহত হন এবং সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে টিআরএম প্রকল্প বাতিল করে দেয়। ফলে ওই চক্র ও সিন্ডিকেট স্থায়ী লুটপাটের মদদ পেয়ে বসে।

২০১৭ সালের ১৬ মার্চ যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রীসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি ও ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি জাতীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। তখন জরিপ ও জনমত যাচাই করে বিল কপালিয়া ও পর্যায়ক্রমে বিলে বিলে টিআরএম প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সে প্রকল্প চক্রের প্রভাবেই বাস্তবায়নে তালবাহানা শুরু হয়। এ বছরের ১০ ডিসেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে পুণঃপর্যালোচনার পর মন্ত্রী টিআরএম বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা হয়নি।

২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ওই প্রকল্প বাতিল করে নতুন প্রকল্প প্রণয়নের নির্দেশ দেয়। হঠাৎ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ভবদহ গেটে এসে টিআরএম হবে না এবং বিলগুলোকে জলাভূমি হিসাবে ঘোষণা দেন। তিনি ডেল্টা প্লান-২১০০ এর অজুহাত উত্থাপন করেন। উপস্থিত জনগণের মধ্যে আপত্তি উঠলে তিনি তাদের সাথে অশোভন আচরণ করেন। প্রকৃত সত্য হলো-ভবদহ এলাকা কখনই জলাভূমি বা জলাশয় ছিল না। এমন তথ্য রাষ্ট্রীয় নথিপত্রেও দেখা যায় না। বরং ডেল্টা প্লান-২১০০ এ ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরকারকে মিথ্যা তথ্য প্রদান করছেন এবং জনমতকে উপেক্ষা করে পাম্পের মাধ্যমে সেচ দিয়ে জলাবদ্ধতা মুক্ত করার অবিবেচনাপ্রসূত প্রকল্প দিয়ে অর্থ অপচয় করেছে। জনমত উপেক্ষা করে ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছে এবং ৪৫ কোটি টাকার সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে যে অর্থ সম্পূর্ণ অপচয় হ এবং বরাবরের মতো জনদুর্ভোগ মারাত্মক আকার ধারণ করবে।

জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের বরাদ্দ একনেকে পাস হলেও বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে অহেতুক বিলম্ব করে গণদুর্ভোগ জিইয়ে রাখা হয়েছে। এবং ৫ মাস যাবত গেট বন্ধ রেখে পানি নিষ্কাশন বন্ধ করা হয়েছে। ৫ মাস যাবত কপাট উঠানামার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীর বেতন প্রদান করা হয় না বলে ওই কর্মচারি দায়িত্ব পালন করে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এহেন দায়িত্বহীনতা ক্ষমার অযোগ্য।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনৈতিক জনস্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে ২১ ভেন্ট থেকে বারোয়াড়ি মোহনা পর্যন্ত ৫০-৬০ কিলোমিটার নদী হত্যা করা হয়েছে। তাদের ভূমিকা সরকারের বিরুদ্ধে উষ্কানিমূলক। ফলে অনভিপ্রেত যে পরিস্থিতির উদ্ভব হতে যাচ্ছে তার সমস্ত দায় তাদেরকেই নিতে হবে। এই গণবিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রের দায় সরকারের উপরেও বর্তাচ্ছে।

Check Also

বিদ্যুৎস্পৃষ্টে একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যু

মৌলভীবাজারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। জুড়ী উপজেলার পূর্ব জুড়ী ইউনিয়নের পূর্ব গোয়ালবাড়ি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।