দক্ষিণ উপকূলের জেলেরা বলছেন, সাধারণত বর্ষা মৌসুমে সাগরে লঘুচাপ বা নিম্নচাপ হলেও বড় ধরনের ঝড় কিংবা এসব ঝড়ে ট্রলারডুবি ও জেলেদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে না। কিন্তু এবার কোনো রকম ঘূর্ণিঝড় ছাড়াই নিম্নচাপের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ের তাণ্ডব দেখেছেন উপকূলের জেলেরা।

জেলেদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান লয়েডস রেজিস্টার ফাউন্ডেশনের ‘ফিশসেফ’ ২০২৫ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ হাজার ৩৫০ জনেরও বেশি জেলে শুধু নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবে সাগরে মারা যান।

নিরাপত্তা সরঞ্জাম বলতে কিছুই নেই

‘ফিশসেফ’ ২০২৫ প্রকল্পের তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায় বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী জেলার সমুদ্রগামী অন্তত ২০ জন জেলের সঙ্গে কথা বলে। এসব এলাকার জেলেরা বলেন, সমুদ্রগামী ট্রলারে জেলেদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম বলতে চার থেকে পাঁচটি বয়া ছাড়া আর কিছুই থাকে না। লাইফ জ্যাকেট দেওয়ার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের অনাগ্রহ আছে।

একই সঙ্গে ট্রলারগুলোয় দিক নির্ণয়ের জন্য কোনো যন্ত্রও নেই। ঝড়ের কবলে পড়লে জেলে ও মাঝিরা দিকহারা হয়ে ভেসে যান দেশের সমুদ্রসীমা ডিঙিয়ে ভিনদেশে। আটক হয়ে মাসের পর মাস সেখানে থাকতে হয়। মুক্তি পেতে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। এ ছাড়া সাগরে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কোনো কিটবক্সও নেই কোনো ট্রলারে।

মালিকপক্ষ কেন ট্রলারে জেলেদের নিরাপত্তায় লাইফ জ্যাকেট দিতে আগ্রহী নন—এমন প্রশ্ন করা হলে অন্তত ১০ জন জেলে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মূলত মালিকেরা মনে করেন, জেলেদের লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হলে ঝড়ের সময় জেলেরা ট্রলার ফেলে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে জীবন বাঁচাতে সাগরে ঝাঁপ দেবেন। এতে তাঁদের ট্রলার ও সম্পদ অরক্ষিত হবে।

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালিকপক্ষ নিজেদের সম্পদ রক্ষায় জেলেদের জীবন রক্ষার সামগ্রী না দেওয়ার এই রেওয়াজকে অমানবিক বলে উল্লেখ করেছেন। এটা তাঁদের জলদাসে পরিণত করার অপকৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।

ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-২ অ্যাক্টিভিটি বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় এলাকার ৫০ লাখের বেশি মানুষের আয়ের প্রধান উৎস সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ। সমুদ্রে মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত ২০০টিরও বেশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার এবং ৬৭ হাজারের বেশি দেশি ইঞ্জিনচালিত নৌকা রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির গবেষকেরা বলছেন, মৎস্যজীবীরা এখনো প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগরের মৎস্য সম্পদের প্রায় ৮৩ শতাংশ আহরণ করেন। সমুদ্রে মাছ ধরার কাজে যুক্ত এসব নৌযানে আধুনিক জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ও নেভিগেশন সিস্টেমের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেরিন ফিশারিজের পরিচালক শরিফ উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতির যুগে এটা অবশ্যই এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। লাইফ জ্যাকেটের ব্যাপারে মালিকদের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি আমিও জানি। এটা খুবই দুঃখজনক।’

আইন উপেক্ষা করছেন মালিকেরা

পাথরঘাটা লাঠিমারার এলাকার ট্রলারমালিক আবুল হোসেন এবং একই উপজেলার মঠেরখাল এলাকার আরেক মালিক জাফর হাওলাদার বলেন, লাইফ জ্যাকেট ও বয়া থাকে না এটা নয়। কমবেশি সব ট্রলারেই কিছু আছে।

জেলেদের ক্ষতিপূরণসংক্রান্ত সরকারের নীতি অনুযায়ী, মৎস্য অধিদপ্তরে নিবন্ধিত একজন জেলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাত এবং জলদস্যু, বাঘ, কুমির বা বন্য প্রাণীর আক্রমণে মাছ ধরার সময় মারা গেলে বা নিখোঁজ হলে তাঁর পরিবার সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। এ ছাড়া স্থায়ীভাবে পঙ্গু ব্যক্তিদের জন্য সর্বোচ্চ এককালীন আর্থিক সহায়তা হিসেবে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান আছে। সরকারি বিধি-বিধানের আওতায় না থাকায় অধিকাংশ জেলেই এই সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন।

ইকোফিশ-২ অ্যাক্টিভিটির হয়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং দায়িত্বশীলভাবে মাছ ধরতে জেলেদের প্রশিক্ষণ বিষয়ে কাজ করেন বিজ্ঞানী হেদায়েত উল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ এখন দেশের অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই এই বিয়ষটিকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। জেলেদের নিরাপত্তা, মাছ ধরায় আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজনসহ নানা বিষয়ে এ খাতে অনেক কিছু করার রয়েছে। আধুনিকায়ন না করা গেলে এই খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো অসম্ভব।

Please follow and like us:

Check Also

‘জলবায়ুু পরিবর্তন’ —– ঝুঁকিতে উপকূলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি

বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা দুই লাখ ৪০ হাজার কৃষকের আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষীরাঃ ‘জলবায়ুু পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।