সুপেয় পানির অভাবে উপকূলের মানুষ এলাকা ছাড়ছে

আবু সাইদ বিশ্বাস, উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরা থেকে: জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধিতে উপকূলীয় এলাকায় পানিতে লবণাক্ততা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া ঝড়,জ¦লোচ্চাস ও লোনা পানি তুলে চিংড়ি ঘের করার কারণে সাগরের লবণ পানি উপকূলীয় এলাকায় ঢুকে পড়ছে। অন্য দিকে বাঁধ দিয়ে পুরো প্লবনভূমিকে আটকে জলাবদ্ধতা তৈরি করা হয়েছে। আর জলাবদ্ধ এলাকায় পানি আটকে লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে উপকূলীয় অঞ্চলের জনঘনত্ব আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। এতে জীবনধারণের জন্য যে পরিমাণ পানি দরকার, তা মাথাপিছু অনুযায়ী কমে গেছে। ফলে কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকারত্ব। শুধু সুপেয় পানির অভাবে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ উপক’ল ছাড়ছে বলে সূত্র জানায়। খাবার পানির সমস্যা এ অঞ্চলে প্রায় ৬০০-৭০০ বছর আগের। যে কারণে খানজাহান আলীসহ যারা এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য এসে ছিলেন তারা এ অঞ্চলে বড় বড় দীঘি খনন করে মানুষের সূপেয় পানির ব্যবস্থা করে গেছেন। বিশেজ্ঞরা বলছে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ বন্ধ করে দেওয়ায় বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণাক্ততা অনেকাংশে বাড়ছে। পাহাড় থেকে নেমে আসা ভারতের গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করলে লবণাক্ততার পরিমাণ তুলনামূলক কম হতো।

বিশেজ্ঞরা বলছে ভূগর্ভস্থ পানি হলো যেকোনো উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তারা বলছে ভূগর্ভস্থ পানির বয়স কমপক্ষে ৬০০ বছর, ওপরে ২ হাজার ৫০০ বছর। অর্থাৎ আমরা বর্তমানে যে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছি, তার বয়স এমনই। এই ভূগর্ভস্থ পানি পূরণ হতে কমপক্ষে ৬০০ বছর লাগবে। বর্তমানে আমাদের উপকূলীয় এলাকায় কমপক্ষে ৯৮ শতাংশ মানুষ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে যে পরিমাণ পানি তোলা হচ্ছে তা পূরণ হচ্ছে না। যেসব জলাশয় ছিল তা ভরাট হয়ে গেছে।
এদিকে নদী রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের চতুর্থ রোববার বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট নিরসনের দাবিতে খালি কলসি নিয়ে মিছিল করেছে স্থানীয়রা। রবিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বিকালে শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পোড়াকাটলা গ্রামে প্রতীকী মিছিলে সংহতি প্রকাশ করে স্থানীয় শত শত নারী-পুরুষ খালি কলসি নিয়ে অংশ নেন। এসময় তারা বলেন পানির রাজ্যে খাওয়ার পানি নেই। বার বার নদী ভাঙনের ফলে উপকূলের মিষ্টি পানির আধারগুলো লবণ পানিতে ডুবে যায়। খাওয়ার পানি সংগ্রহে উপকূলের নারীদের সবসময় সংগ্রাম করতে হয়। তাদের দাবী উপকূলবাসীকে সুপেয় পানির নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকেই দিতে হবে। সেই সাথে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এরআগে একই দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি পালিত হয়।

এছাড়া শ্যামনগরে বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি হ্রাসে উপজেলার সকল নদী ও খাল দখল মুক্ত করনের দাবীতে ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবিবার শ্যামনগর উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরে ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত হয়। ক্যাম্পেইনে বক্তারা অবিলম্বে নদী ও খাল উন্মুক্তের দাবী জানান। এছাড়া প্রতিবছর ২২ মার্চ পালিত হয় বিশ্ব পানি দিবস। এ দিবসেও সূপেয় পানির জন্য বিভিন্ন দাবী-দাওয়া ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
জানা গেছে, গত ৫০ বছরে দেশের নদ-নদীর সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় থাকা মোট ৩৮৩টি নদীর অনেকগুলোর অবস্থাও সংকটাপন্ন। দূষণ ও ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনের পাশাপাশি অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ন, আবাসন এবং সেতু, কালভার্ট ও স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে ছোটবড় আরও অনেক নদীর অস্থিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব নদী দিবস হিসেবে পালন করতে শুরু করে ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। এরপর ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে। বাংলাদেশে ২০১০ সালে প্রথমবার রিভারাইন পিপল নামের একটি সংস্থা এ দিবস পালন করে।
বিশেজ্ঞরা বলছে লবণাক্ততার কারণে উপকূল অঞ্চলে পুরো বাস্তুসংস্থান বদলে যাচ্ছে। কারণ, পানি হলো জীববৈচিত্র্যের মূল উপাদান। সুতরাং, পানির বৈচিত্র্য পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকার সবকিছুতেই পরিবর্তন হতে থাকে। মানুষের রোগব্যাধি বাড়ছে, নারীরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়ছেন। একসময় দেখা যাবে, শুধু পানির কারণে মানুষের স্থানাস্থার বেড়ে গেছে। মানুষ উপকূল ছেড়ে অন্য এলাকায় ভিড় করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে সূপেয় পানির সমস্যা সমাধানে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক বড় বড় পুকুর, খাল, জলাশয় খনন করে তাতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়া, দক্ষিণ পশ্চিম উপকূল অঞ্চল কে দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করা,উপকূল উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগকে মাথায়রেখে স্থায়ী ও মজবুত বেড়িবাঁধ নির্মাণ , জনসংখ্যার অনুপাতে পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেন্টার সহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলা,ভেড়িবাদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জরুরী তহবিল গঠন, উপকূলীয়সকল মানুষের খাবার পানির টেকসই ও স্থায়ী সমাধান করা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায়বিশ্ব জলবায়ু তহবিল থেকে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় তার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা, দূর্যোগপ্রবণ দক্ষিণ- পশ্চিম উপকূল তুলা, ঝড়-ঝঞ্ঝা নদী ভাঙ্গন ও ভূমিক্ষয়ঠেকাতে উপকূল দ্বীপ চরাঞ্চলে ব্যাপকহারে বৃরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ এবং প্যারাবন বা সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলাসহ নানা পরামর্শ দিয়েছে উপকূল অঞ্চলের সূপেয় পানির স্থায়ী সমাধানে।

আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষীরা
২৬/৯/২০২২
০১৭১২৩৩৩২৯৯

Please follow and like us:

Check Also

নতুন যোগ হচ্ছে ২০ লাখ দরিদ্র

মূল্যস্ফীতির কশাঘাত মোকাবিলায় ২০ লাখ ২৬ হাজার দরিদ্র মানুষকে নতুন করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।