ভারতে কেন নিষিদ্ধ করা হলো ইসলামী সংগঠন পিএফআই

বিবিসি রিপোট:  ভারতের সন্ত্রাস দমন এজেন্সি এনআইএ ও এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) গত কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন রাজ্যে পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার (পিএফআই) দফতরগুলোতে তল্লাশি অভিযান চালিয়ে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আনিস আহমেদসহ অনেক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে।

এক বিবৃতিতে এনআইএ অভিযোগ করেছে, ধৃতরা ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপ’কে সমর্থন করেন।

তবে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে পিএফআই এই অভিযোগগুলোকে অসাড় ও চাঞ্চল্যকর বলে অস্বীকার করেছে।

কবে, কিভাবে গঠিত হয়েছিল পিএফআই?
গত শতাব্দীর ৮০’র দশকে যখন থেকে ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রসার ঘটতে শুরু করেছিল, আর এরপরে যখন ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল, তারপর ভারতের সরকার এবং রাজনীতির প্রতি মুসলমানদের চিন্তাভাবনায় একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে শুরু করে বলে মন্তব্য করেছিলেন সমাজবিজ্ঞানী জাভেদ আলম।

দিল্লির জামা মসজিদের ইমাম আহমেদ বুখারীর ‘আদম সেনা’ অথবা বিহারের ‘পসমন্দা মুসলিম মহাজ’ বা মুম্বাইয়ের ‘ভারতীয় সংখ্যালঘু সুরক্ষা মহাসংঘ’ প্রভৃতি সংগঠন সেই সময়েই তৈরি হয়েছিল।

আবার কেরালায় ‘ন্যাশনাল ডেভলমেন্ট ফ্রন্ট’, তামিলনাডুর ‘মনিথা নিথি পসারাই’ আর ‘কর্ণাটক ফোরাম ফর ডিগ্নিটি’র মতো সংগঠনও ভূমিষ্ঠ হয় সেই পর্যায়ে।

এই তিনটি সংগঠন ২০০৪ সাল থেকেই নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া-সমঝোতা শুরু করে।

২০০৬ সালের ২২ নভেম্বর কেরালার কোঝিকোডে এক বৈঠকে এই তিনটি সংগঠন মিশে গিয়ে ‘পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া’ বা পিএফআই তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর নতুন সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম নেয় ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি।

আরো কিছু সংগঠন মিশে যায় পিএফআই-তে
কেরালা, তামিলনাডু আর কর্নাটকের তিনটি সংগঠন এক ছাতার তলায় চলে আসার পরে গোয়া, রাজস্থান, অন্ধ্র প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ আর মনিপুরের পাঁচটি সংগঠনও মিশে যায় পিএফআইয়ের সাথে।

পিএফআই দাবি করে যে তারা ভারতের সব চাইতে দ্রুত বেড়ে চলা ‘ক্যাডারভিত্তিক গণআন্দোলন’। ২৩টি রাজ্যে তাদের চার লাখ সদস্য আছে বলেও দাবি করে পিএফআই।

নিজেদের ওয়েবসাইটে পিএফআই আরো দাবি করে, তাদের উদ্দেশ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা রক্ষা করা এবং জাতীয় ঐক্য ও অখণ্ডতার জন্য কাজ করা।

তবে পিএফআইয়ের ব্যাপারে ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা ভিন্ন।

সংগঠনটির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা, অবৈধ কার্যকলাপে যুক্ত থাকা, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো এবং ভারতের অখণ্ডতার ক্ষতি করার প্রচেষ্টার অভিযোগ এনেছে নিরাপত্তা এজেন্সিগুলো। সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগেও এজেন্সিগুলো একের পর এক মামলা দায়ের করেছে পিএফআইয়ের বিরুদ্ধে।

সিমি’র সাথে সম্পর্কের অভিযোগ
রাজস্থানে এক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর হত্যার ঘটনাতেও পিএফআইয়ের নাম যুক্ত করা হয়েছিল।

আবার বিহারের পাটনায় পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে এমন কিছু নথি উদ্ধার করার দাবি করেছিল, যেখানে ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতে ইসলামী রাজ্য তৈরির একটা পথ-দিশা ছিল।

পুলিশের উদ্ধার করা ওইসব নথি জাল বলে সেই সময়েই দাবি করেছিল পিএফআই।

পিএফআইয়ের দপ্তরগুলোতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বার বার তল্লাশি অভিযান চলেছে আর তাদের নিষিদ্ধ করা হলো বুধবার। কিন্তু নিরাপত্তা এজেন্সিগুলো তাদের ওপরে নজর রাখছে সেই ২০০৭ সাল থেকেই।

পিএফআইয়ের ওপরে নজর
পিএফআইয়ের ওপর সন্ত্রাস দমন এজেন্সি এনআইএ’র নজর পড়ে ২০০৮ সালে।

অধ্যাপক টি জে জোসেফের ঘটনায় মনমোহন সিং সরকারের সময় থেকে কেন্দ্রীয় তদন্ত এজেন্সিগুলোকে যুক্ত করা হয়। কেরালার মালয়লাম ভাষার অধ্যাপক টি জে জোসেফের ওপরে হামলা হয়, তার হাত কেটে দেয়া হয়েছিল।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে তিনি ইসলামের নবীর সম্বন্ধে কটূ কথা বলেছেন।

পিএফআই তৈরি হওয়ার পর থেকেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতো যে আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা কট্টরপন্থী সংগঠন স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া বা ‘সিমি’রই একটা প্রকাশ্য রূপ এই নতুন সংগঠন পিএফআই।

২০০১ সালে ভারত সরকার যেসব সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে নিষিদ্ধ করে দেয়, সেই তালিকাতেই রয়েছে ‘সিমি’র নাম।

আবার ‘সিমি’র সাথে আরেকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে ঘোষিত ইন্ডিয়ান মুজাহিদীনেরও যোগাযোগ আছে- এমন দাবি করা হয়ে থাকে। ভারত সরকার ইন্ডিয়ান মুজাহিদীনকেও অবৈধ কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।

তবে পিএফআইয়ের সাথে ‘সিমি’র সম্পর্কের অভিযোগ এ জন্য আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়, কারণ সিমি’র বেশকিছু সাবেক নেতা পিএফআইতে যোগ দিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

এমন দাবিও করা হয় যে সিমিকে নিষিদ্ধ করার কারণেই তার সদস্যরা নতুন নাম দিয়ে একটা সংগঠন তৈরি করেন। তবে সিমি নিষিদ্ধ হওয়ার প্রায় ছয় বছর পরে পিএফআইয়ের জন্ম।

পিএফআইয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অধ্যাপক পি কোয়া অবশ্য বিবিসিকে দেয়া এক পুরনো সাক্ষাৎকারে সিমির সাথে তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি ‘এনডিএফ’র সংস্পর্শে আসেন ১৯৯৩ সালে, আর সিমি’র সাথে তার সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিল ১৯৮১ সালেই।

যে সংগঠনগুলো মিশে গিয়ে পিএফআই তৈরি হয়েছিল, তারই অন্যতম ছিল এনডিএফ।

পিএফআই সাংগঠনিকভাবে কতটা মজবুত?
পিএফআই যদিও তাদের সদস্য সংখ্যা নিয়ে বড় দাবি করে, তবে রাজনৈতিকভাবে তারা কেরালা আর কর্নাটকের কিছু অংশেই সাধারণ কিছু সাংগঠনিক সাফল্য পেয়েছে।

কর্নাটকে আগামী বছরে বিধানসভার নির্বাচন আছে। ওই রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে পিএফআইয়ের প্রভাব এখন বাড়ছে বলে মনে করা হয়।

আবার কেরালায় রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলোতেও পুলিশ পিএফআইয়ের দিকে আঙ্গুল তুলে থাকে।

কর্নাটকের স্কুলগুলোতে হিজাব পরার অধিকার নিয়ে যে মামলা চলছে, সেখানে সরকারি আইনজীবী আদালতেই দাবি করেছিলেন যে পিএফআই-ই ঘটনাটিকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করছে।

এ-ও বলা হয়েছিল যে তারা মুসলমান নারীদের মাথায় এটা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে হিজাব পরতেই হবে।

সেই মামলায় ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া আর ন্যাশনাল উইমেন্স ফ্রন্টেরও নাম উঠে এসেছিল। পিএফআইয়ের সাথে এই সংগঠন দুটিকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া বা এসডিপিআই-কে মনে করা হয় পিএফআইয়ের রাজনৈতিক দল। তাদেরকে অবশ্য নিষিদ্ধ করেনি ভারত সরকার।

পিএফআইয়ের ঘোষিত এজেন্ডা
সংগঠনটির দাবি অনুযায়ী, এক বৈষম্যহীন সমাজ গড়া তাদের লক্ষ্য। সেই সমাজে প্রত্যেকের জন্য স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার আর নিরাপত্তা থাকবে। এই পরিবর্তন আনার জন্য তারা বর্তমান অর্থনৈতিক নীতিমালাতেও বদল আনতে চায়, যাতে তাদের সেই কাঙ্ক্ষিত সমাজে দলিত, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুরাও অধিকার পায়।

ভারত সরকার অবশ্য পিএফআইয়ের এসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্যর সাথে সহমত নয়। পিএফআইয়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা একের পর এক মামলায় দেশদ্রোহ, অবৈধ কার্যকলাপে যুক্ত থাকা, হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা ছড়ানো, বিদেশী অর্থায়নের মাধ্যমে ভারতের অখণ্ডতার ক্ষতিসাধন করা এবং অশান্তি ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

সূত্র : বিবিসি

Check Also

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি গ্রেফতার

প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ইয়াছিন আলীকে গ্রেফতার করা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।