সমাবেশে ‘মানুষের ঢল’ ঠেকানোর ধর্মঘটে ঠকছে মালিক-শ্রমিক

সরকারবিরোধীদের সমাবেশে ‘মানুষের ঢল’ ঠেকাতে ডাকা ধর্মঘটে শুধু জনদুর্ভোগ নয়; সাধারণ পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরও হচ্ছে আর্থিক ক্ষতি। তবে ক্ষতির অঙ্ক বলছেন না সরকার সমর্থক পরিবহন নেতারা। সাধারণ মালিক ও শ্রমিকদের ভাষ্য, লোকাল বাস এক দিন বন্ধ থাকলে মালিক তিন হাজার টাকা মুনাফাবঞ্চিত হন। চালক-শ্রমিক আয় হারান দুই হাজার টাকা। দূরপাল্লার বাসে লোকসানের অঙ্ক আরও বেশি।

গত এক মাসে যেখানেই বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ হচ্ছে, সেখানেই ধর্মঘট ডাকা হচ্ছে। মহাসড়কে অবৈধ তিন চাকার যান চলাচলকে ‘কারণ’ বলা হলেও, সময় ও ধরন বলছে, সমাবেশ ঠেকাতেই এসব ধর্মঘট।
ঢাকা-ময়মনসিংহ পথের হিসাব ধরে বাস বন্ধের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাব্য পরিসংখ্যান তৈরি করেছে সমকাল। ওই পথের বাস ভাড়া ৩২০ টাকা। ৪০ আসনের বাসের ৭৫ শতাংশ যাত্রী পূর্ণ ধরে দুই ট্রিপে (আসা-যাওয়া) মালিকের আয় ৩৮ হাজার ৪০০ টাকা। লাগে সাড়ে ১৫ হাজার টাকার ডিজেল। পথের খরচা ও চালক-শ্রমিকের বেতন মিলিয়ে ১৪ হাজার টাকা। সরকারের বিভিন্ন ফি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধের পর নিট মুনাফা পাঁচ হাজার টাকা। ধর্মঘটের দুই দিনে বাসপ্রতি লোকসান ১০ হাজার টাকা।

২০১৩ ও ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধে পরিবহন খাতে মারাত্মক ক্ষতি হয়। ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি জানিয়েছিল, দৈনিক ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের ৯ মার্চ সংসদে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, ২৯ দিনের হরতাল-অবরোধে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ১৫ কোটি ৬২ লাখ ৬৩ হাজার ১০০ টাকা।
গত শনিবার বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ ছিল ফরিদপুরে। সমাবেশ ঘিরে ওই অঞ্চলে দু’দিন ধর্মঘটের কারণে বাস বন্ধ ছিল। এর আগে খুলনা, রংপুর, বরিশালেও গণসমাবেশ সামনে রেখে দু’দিন করে বাস ধর্মঘট ছিল। সমাবেশ শেষ হতেই চালু হয়ে যায় বাস। এর পর থেকে তিন চাকার যানবাহন এবং বাস ওইসব এলাকার মহাসড়কে এক সঙ্গেই দিব্যি চলছে।

রাজধানীর গাবতলী থেকে ঢাকা-বরিশাল পথে বাস চালানো একটি পরিবহনের মালিক সমকালকে জানিয়েছেন, সমাবেশের কারণে ২৮ থেকে ৫ নভেম্বরের মধ্যে চার দিনই ধর্মঘট ছিল। তাঁর ১২টি বাসে এই চার দিনে আড়াই লাখ টাকার লোকসান হয়েছে। দূরপাল্লার বাস বলে চালক-শ্রমিককেও বেতন দিতে হয়েছে। ব্যাংক ঋণের কিস্তি দিতে হবে মাস শেষে।

বাস মালিকরা বলছেন, পরিবহন নেতাদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যুক্ত। এসব ধর্মঘটে সরকারের সমর্থন থাকে। তাই নেতারা ক্ষতির কথা বলছেন না। সাধারণ মালিকরা ভুগছেন। করোনা মহামারির সময় সব ধরনের গাড়ি বন্ধ থাকায় পরিবহন খাতে দৈনিক ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল বলে দাবি মালিক সমিতির। এবারের ধর্মঘটে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে- এ প্রশ্নে সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সমকালকে বলেন, এসব ধর্মঘট কেন্দ্রীয়ভাবে ডাকা হয় না। স্থানীয়ভাবে মালিক-শ্রমিকরা ডাকেন। ধর্মঘট বিচ্ছিন্নভাবে হচ্ছে। ক্ষতিও হচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে।

স্থানীয় নেতারাও ক্ষতির পরিমাণ বলছেন না। বরিশালের বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি গোলাম মাশরেক বাবলু বলেন, ক্ষতির এখনও হিসাব করিনি। এগুলো নিয়ে ঝামেলার মধ্যে আছি।
ক্ষমতায় থাকতে বিএনপিও বিরোধীদের কর্মসূচিতে মানুষের ঢল ঠেকাতে গণপরিবহন বন্ধ রাখতে বাধ্য করত। তবে বিএনপি সমর্থক পরিবহন নেতাদের দাবি, এবার ক্ষতির পরিমাণ ওই সময়ের চেয়ে বেশি। বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী ও সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস সমকালকে বলেন, সরকারের ভয়ে অনেক পরিবহন নেতা গণবিরোধী ধর্মঘটের ক্ষতি নিয়ে কথা বলছে না। তবে মালিকের ব্যবসা ও শ্রমিকের মজুরি নষ্ট হচ্ছে সরকারি ধর্মঘটে।

ফরিদপুরে দুই দিনের ধর্মঘটে বাস মালিকদের ২২ লাখ এবং শ্রমিকদের ২৩ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। সাধারণ মালিক ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন, এ অঞ্চলে ৫৭৬টি বাস ও মিনিবাস লোকাল এবং আন্তঃজেলা রুটে চলাচল করে। ফরিদপুর জেলা বাস মালিক গ্রুপের নির্বাহী কমিটির সদস্য কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী এবং জেলা মিনিবাস মালিক গ্রপের সহসভাপতি মো. শাহীন চৌধুরী জানান, মিনিবাসে প্রতিদিন মালিকের আয় দেড় হাজার টাকা। দূরপাল্লার বাসে মালিকের দৈনিক মুনাফা আড়াই হাজার টাকা। এই হিসাবে ২২ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে দুই দিনে।

ফরিদপুরের ধর্মঘটে গোপালগঞ্জের বাসও চলেনি। এতে লোকসান ১০ লাখ টাকা। গোপালগঞ্জ মালিক সমিতির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন জানান, ফরিদপুর রুট হয়ে কমফোর্ট লাইনের তিনটি, গোল্ডেন লাইনের চারটি, সেবাগ্রিন লাইনের তিনটি, সুবর্ণ পরিবহনের দুটি এবং দিগন্ত পরিবহনের ১০টি বাস চলে। দু’দিনের ধর্মঘটে ৮৮ট্রিপ বন্ধ ছিল।

দিগন্ত পরিবহনের চেকার মিলন শেখ জানান, প্রতি ট্রিপে মালিক ১০ হাজার টাকা পান। আর চালক, হেলপার ও সুপারভাইজার পান দেড় হাজার টাকা।

কমফোর্ট লাইনের শ্রমিক মিজান মোল্লা জানান, ধর্মঘটের দু’দিন কাজে যাননি। মজুরিও পাননি। দুর্মূল্যের বাজারে তাঁর লোকসান এক হাজার টাকা। দিগন্ত পরিবহনের চালক মিয়া বলেন, গাড়ি বন্ধ থাকলে পেটে ভাত যায় না। তাই ধর্মঘট না হওয়াই ভালো। গোপালগঞ্জের বাস মালিক হাসেম আলী বলেন, দু’দিনে গাড়িপ্রতি ২০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। রাজবাড়ী-ফরিদপুর রুটের বাসচালক রইস উদ্দিন জানান, মালিক বন্ধ রাখতে বলায় বাস চালাননি। এর বেশি বলার নেই।
বাস মালিক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘নেতাদের জিজ্ঞাসা করুন, লোকজনকে জিম্মি করে সাধারণ মালিকদের ক্ষতি করে কী লাভ হলো।’

সবচেয়ে ‘কড়া’ ধর্মঘট ছিল বরিশালে। নগরের কাউনিয়ার নুরুল ইসলাম ইজিবাইক চালান। তিনি জানান, দু’দিনের ধর্মঘটে গাড়ি চালাতে না পারায় ১ হাজার ৬০০ টাকা লোকসান হয়েছে।
বরিশালের একাধিক পরিবহন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ধর্মঘটে লোকাল বাসে দৈনিক ৬ হাজার এবং দূরপাল্লার বাসে ১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত লোকসান হয়েছে। সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা। ধর্মঘটের কারণে যে ভোগান্তি হয়েছে, সে কারণে সাধারণ মানুষ পরিবহন মালিক-শ্রমিকবিরোধী হয়ে উঠেছেন।

ঢাকা-বরিশাল পথের ইলিশ পরিবহনের চালক মো. ফিরোজ বলেন, প্রতি সিঙ্গেল ট্রিপে চালক ৬০০ ও সুপারভাইজার ৫০০ টাকা করে পান। মালিকের গড় আয় ৭ হাজার টাকা। দিনে তিনটি সিঙ্গেল ট্রিপ হয়।
বরিশালে লঞ্চও বন্ধ ছিল বিএনপির সমাবেশের আগের দিন থেকে। বরিশালের অভ্যন্তরীণ ১১ রুটে অর্ধশত এবং ঢাকা-বরিশাল রুটে ২৪ লঞ্চ চলে। নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বরিশাল জেলা সভাপতি মো. হাশেম বলেন, মালিক-শ্রমিক সবারই লোকসান হয়েছে।

১২ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের সময় অঘোষিত ধর্মঘটে গাড়ি বন্ধ থাকায় ময়মনসিংহের পরিবহন খাতে ৬ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। জেলা মোটর মালিক সমিতি কোচ বিভাগের সম্পাদক সোমনাথ সাহা জানান, আন্তঃজেলা, লোকাল, দূরপাল্লা মিলিয়ে ময়মনসিংহ থেকে ৫০০ বাস চলে। এক দিন বাস বন্ধ থাকলে ২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। দু’দিনে ক্ষতি ৪ কোটি টাকা। বিএনপির সমাবেশ মানে জ্বালাও-পোড়াও। তাই মালিকরা স্বেচ্ছায় বাস বন্ধ রেখেছিলেন দাবি সোমনাথ সাহার।
ময়মনসিংহ জেলা অটোটেম্পো, সিএনজি, মাহিন্দ্র শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল হোসেন জানান, ৯ হাজার ছোট গাড়ি চলে। বন্ধ থাকলে গাড়িপ্রতি দৈনিক ক্ষতি ১ হাজার ২০০ টাকা। এই হিসাবে দু’দিনে ক্ষতি ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থেকে ঢাকা রুটে আলম এশিয়ার ৮০টি বাস চলে। একটি বাসের চালক ইসমাইল হোসেন বলেন, গাড়ি না চললে দিনে ১৫ হাজার টাকা লোকসান হয়।

খুলনা আন্তঃজেলা মিনিবাস কোচ মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সোনা বলেন, তিন সমিতির ৮০০ বাসের সব প্রতিদিন চলে না। প্রতিদিন যে পরিমাণ গাড়ি চলে, তা বন্ধ থাকলে দিনে কোটি টাকা ক্ষতি হয়। এই পরিবহন নেতার দাবি, বাস বন্ধ হলে সবারই কষ্ট। নিজস্ব দাবিতে ধর্মঘট ছিল। তাই বৃহত্তর স্বার্থে কষ্ট মেনে নিয়েছেন মালিক-শ্রমিকরা। তাই সরকারের কাছ থেকে সাহায্যের প্রশ্ন আসছে কেন?

খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাহিদ খান বলেন, ধর্মঘটের দিন চালক, শ্রমিকরা মজুরি পান না। এবারও পাননি।

রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী টিটু বলেন, জেলায় ৬০০ বাস রয়েছে। এক দিন বন্ধ থাকলে বাসপ্রতি লোকসান ৫ হাজার টাকা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বন্ধ হলে অর্থনীতিরই ক্ষতি।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন খুলনা ব্যুরোর মামুন রেজা ও হাসান হিমালয়, বরিশাল ব্যুরোর সুমন চৌধুরী, ফরিদপুরের প্রতিবেদক হাসানুজ্জামান, ময়মনসিংহ প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান, গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি মনোজ সাহা, রাজবাড়ী প্রতিনিধি সৌমিত্র মিত্র, পীরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি মাজহারুল ইসলাম মিলন]

Please follow and like us:

Check Also

আবুল কাশেম কোন প্রতিহিংসার রাজনীতি করেননি,তাই জনগণ তাকে বার বার নির্বাচিত করতেন: সাতক্ষীরায় মিয়া গোলাম পরওয়ার

সাতক্ষীরা সংবাদদাতাঃ কলারোয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, উপজেলা জামায়াতের প্রথম সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।