ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র আশঙ্কায় আতঙ্কিত উপকূলের লাখ লাখ মানুষ: অরক্ষিত বেঁড়ি বাঁধে জনজীবনে সংকট বাড়ছে

আবু সাইদ বিশ্বাস  , ক্রাইমবাতা রিপোট, সাতক্ষীরা: বিস্তীর্ণ উপকূলের যথাযথ সুরক্ষা না থাকায় উপকূলের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধ ক্ষতবিক্ষত হয়ে সাগর তীরবর্তী উপকূলীয় ২১ টি জেলায় লাখ লাখ মানুষের বসবাস হুমকির মুখে পড়েছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মেরামতে শভঙ্করের ফাঁকি থাকায় লাখ লাখ মানুষ জলোচ্ছ্বাসে ঘর ও জীবিকা হারিয়েছে। চলতি সপ্তাহে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানতে পারে এমন আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। প্রাকৃতিক দুযোর্গ, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভঙ্গুর বের্ড়িবাঁধের কারণে বসবাস অনুপযোগী হচ্ছে এসব অঞ্চল। ১৯৬০ সালে পাকিস্থান আমলে নির্মিত উপকূল রক্ষার বাঁধগুলো শতভাগ নিরাপত্তা দিতে না পারায় উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, ও চট্টগ্রাম এলাকায় ৮ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। আকাশে মেঘ ডাকলেই মানুষরা আঁতকে ওঠেন। পানি একটু বাড়লেই ঘুম বন্ধ হয়ে যায় তাদের। ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে এসব উপকূলের কোটি বাসিন্দারা। টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তনদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বিস্তৃত বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা।
জানা গেছে, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় বাঁধগুলোর নকশা ১৯৬০ থেকে ৬৫ সালের। সমতল থেকে বাঁধগুলোর উচ্চতা ১০ ফুট। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় ১২ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস ছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রায় ২০০ বছর ধরে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষ চরমভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রের অভাবে এসব দুর্যোগে গত ৫০ বছরে ৯টি ঘূর্ণিঝড়ে ৪ লাখ ৭৫হাজার প্রাণহানি হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় ৮ হাজার ৯০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার জনগণ অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে জীবনযাপন করছে বলে এক গবেষণা থেকে জানা গেছে।
দেশের শতকরা ২৫ ভাগ জনগণ উপকূল অঞ্চলে বসবাস করে। জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ অবদানও এই অঞ্চলেরই। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চল, এখানকার অবকাঠামো এবং বসবাসকারী জনগণের অর্থনৈতিক জীবন নানান দৈব-দুর্বিপাক, বৈষম্য, অবহেলা আর অমনোযোগিতার শিকার। সূত্র বলছে দেশের অন্যতম দুটি সামুদ্রিক বন্দর, প্রাকৃতিক সম্পদের স্বর্গ সুন্দরবন এবং পর্যটন সম্ভাবনা সমৃদ্ধ কক্সবাজারকে কার্যকর অবস্থায় পাওয়া জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন অভিযাত্রার জন্য যে কত জরুরি তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। এমতাবস্থায়, উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিঅর্থনীতি ও বিশে^র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের সুরক্ষা নিয়ে ভবিষ্যবাদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি আগামী দিনে বঙ্গোপসাগরকেন্দ্র্রিক সমুদ্রঅর্থনীতি বা ‘নীল অর্থনীতি’ বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলকে গড়ে তুলতে প্রয়োজন বিশেষ পরিকল্পনা। এসব লক্ষ্য পূরণে জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দসহ একটি ‘উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন করে বিশদ জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
সূত্রমতে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার, এর মধ্যে সুন্দরবন ১২৫ কিলোমিটার, নদীর মোহনা ও ছোট বড় দ্বীপমালা ২৭৫ কিলোমিটার, সমতল ও সমুদ্র সৈকত ৩১০ কিলোমিটার। দেশের প্রধান দুটি সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা, বিশ্বের সেরা গহিন গরান বন সুন্দরবন এবং বিশ্বের দীর্ঘতম অখন্ডিত (আনব্রোকেন) সমুদ্র সৈকত বা বেলাভূমি কক্সবাজার অবস্থিত। ১৭৯৭ থেকে শুরু করে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ের শুমার পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছে মোট ৪৮০ বার মাঝারি ও মোটা দাগের জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের উপকূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ৩২৯টি, এসেছে গড়ে ৫-১০ বছর পর পর। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার কিছুটা আগে থেকে বিগত ৬১ বছরে ১৮৮টি ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস ঘটেছে ঘন ঘন।
দুর্যোগ এলেই সংবাদমাধ্যমে দৃষ্টিগোচর হয় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢোকার সংবাদ। এরপর দুর্যোগ কেটে গেলে আর সেই বেড়িবাঁধের খবর থাকে না। খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলে সেসব বাঁধ জীবনের প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ স্বে”াশ্রমে গড়ে তোলে। সরকারও হয়তোবা বাজেট দেয়। কিন্তু সেই বাজেট কাগজে কলমেই থেকে যায়। সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকাকে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা ঘোষণা, পৃথক উপকূলীয় বোর্ড গঠন এবং জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দসহ ২১ দফা দাবি সাতক্ষীরা বাসির। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার নয় বছরে বেড়িবাঁধ সংস্কারে ১৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বাঁধা হয়নি উপকূলীয় বাঁধ। সাতক্ষীরার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ সংস্কারে সরকার শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। অথচ পানি উন্নয়ন বোপর্ডের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে সেই বাঁধ সংস্কার করা হয়নি। যে কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙে বাড়িঘর ও সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। চরম দুর্ভোগের শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে দক্ষিণ জনপদের কয়েক লাখ মানুষ। শুধু তাই নয়, স্থানীয় জনগণ স্বে”শ্রমে বাঁধ সংস্কার করে আর বিল তুলে নেয় সরকারি কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশের উপকূলীয় পোল্ডারগুলো অনেক পুরোনো। বেশির ভাগেরই বয়স ৫০-৬০ বছরের বেশি। এগুলো মাটির তৈরি হওয়ায় এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। এছাড়া গঙ্গা ব্যারেজের কারণে ফারাক্কা বাঁধের জন্য ওপর থেকে পানি আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ওপর থেকে স্বাদু পানির প্রবাহ না থাকায় নদীর লবণাক্ততা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। উপকূলীয় অঞ্চলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে জনজীবনে সংকট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাঁরা বলছে আগে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এই সংকট দেখা দিলেও এখন স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতেই উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে ওই অঞ্চলের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে দেশের উপকূলীয় এলাকা অবকাঠামোগত দিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তাছাড়া গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এবং দেশের অভ্যন্তরে আরো ৫০টির বেশি নদী উপকূলীয় এলাকার মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। আবার মওসুমি জলবায়ুর প্রভাবে উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানি, সাইকোন, ব্যাপক বৃষ্টিপাত, নদীর উপচেপড়া পানিপ্রবাহ বন্যার সৃষ্টি করে এবং উপকূলীয় জনপদ প্লাবিত করছে।

Please follow and like us:

Check Also

ইমাম ও মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ

রাকিবুল ইসলাম, আলিপুর,২৩শে এপ্রিল ২০২৪:সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন সাতক্ষীরার আয়োজনে ইমাম ও মুয়াজ্জিন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।