কেবল ভিসা নীতিতে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবার গ্যারান্টি নেই

* স্থানীয় সরকার বা সংসদীয় উপনির্বাচন কোনো দৃষ্টান্ত হতে পারে না

* বিরোধীদলীয় কর্মসূচিতে পুলিশ ও আ’লীগের বাধা অব্যাহত

* সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালে দলীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা, বর্তমান

সংসদ যথারীতি বহাল থাকবে

* নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কিত কোনো বিধান সংবিধানে নেই

* নির্বাচনের দিন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো ভোটের প্রকৃত ফলফলের নিশ্চয়তা

সরদার আবদুর রহমান : আগামী জাতীয় নির্বাচন কেবল ‘মার্কিন ভিসা নীতি’র প্রভাবেই নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে বলে মনে করেন না বিশেষজ্ঞরা। কেননা সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান দলীয় সরকার পূর্ণঅবয়ব নিয়েই নির্বাচনকালে ক্ষমতায় সমাসীন থাকার সুবিধা নিবে।

মুখে ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠিত হবার কথা বলা হলেও বর্তমান সংবিধানে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী দলীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীসভা এবং বর্তমান জাতীয় সংসদ যথারীতি বহাল থাকবে। নতুন নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ শপথ না নেয়া পর্যন্ত বিদ্যমান এমপিগণও বহাল থাকবেন। সরকারের সাজানো আমলাতন্ত্র ও বিভিন্ন বাহিনীও সরকারের আজ্ঞাবহই থাকবে। এরা নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে বলা হলেও কার্যত ঘুড়ির নাটাই সরকারের হাতেই থেকে যাবে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত। অন্যদিকে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্প্রতি ঘোষিত মার্কিন ভিসা নীতি প্রভাব সৃষ্টি করবে বলে কোনো কোনো মহল থেকে ব্যাপক আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে। সর্বসাম্প্রতিক গাজীপুর সিটির নির্বাচনে এই নীতির প্রতিফলন দেখা গেছে বলেও দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে মূল নির্বাচনের সময়ে এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া কতোটুকু কার্যকর থাকবেÑ এনিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে সন্দেহ রয়েছে। ভোটের দিন সবকিছু শান্তিপূর্ণ থাকাই শুধু নয়Ñ ভোটের ‘প্রকৃত’ ফল নিয়ে ফেরার নিশ্চয়তাকেও সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।

ভিসার প্রভাব প্রসঙ্গে  : বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন ভিসা নীতির প্রভাবে শুধু ভোটের দিন শান্তি বজায় থাকা এবং আগ্রহীদের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারা যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে কথাটি হয়তো সত্য। প্রায় ১০ বছর ভোট দিতে না পারার কারণে এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন মানে শুধু ভোটের দিনে ভোট দিতে পারা নয়; বরং নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সমান সুযোগ, অংশগ্রহণ এবং আচরণবিধি প্রতিপালনও আবশ্যক। সেই সঙ্গে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো ভোটের প্রকৃত ফল নিয়ে ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা লাভ। গাজীপুরের নির্বাচন শুধু প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বর্জন নয়, এমনকি ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়েও অসম প্রতিযোগিতা ছিল।

বিশ্লেষকদের আরো অভিমত, অন্য যে চারটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেগুলোও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি দলের বর্জনের কারণে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে গণ্য হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং, সেগুলোয় কমিশনের চ্যালেঞ্জ কার্যত তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। গণতান্ত্রিক নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে দুর্বল বা বাধাগ্রস্ত করে যেসব কাজ, সেগুলো তখনই প্রকট হয়, যখন তা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেÑ এমন সম্ভাবনা তৈরি করে। তাই স্থানীয় সরকার বা সংসদীয় আসনের যে উপনির্বাচন সামনে অনুষ্ঠিত হবে, এগুলোকে জাতীয় নির্বাচনের মহড়া হিসেবে দেখার কোনো অবকাশ নেই।

কর্মসূচিতে বাধা অব্যাহত : এদিকে নির্বাচনের আগে ভিসার ‘হুমকি’র কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। নতুন ভিসা নীতি ঘোষিত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধীদলীয় কর্মসূচিতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাধা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। সর্বসাম্প্রতিক এসব ঘটনাগুলোর নজির তুলে ধরে বিশ্লেষকরা বলছেন, সবাই তো আমেরিকা যাওয়ার সামর্থ রাখে না, তাদের সে রকম সাধও নেই।

 

ধানমন্ডি, কেরানীগঞ্জ, বগুড়া, বরগুনা, নাটোর, কুমিল্লা ও কুষ্টিয়ার ঘটনাগুলোয় দেখা গেছে, হয় পুলিশ নয়তো আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। এমনকি হামলাতেই ঘটনা শেষ হচ্ছে না, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের অফিসে বিএনপির মিছিল থেকে আক্রমণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলই আক্রান্ত হিসেবে নিজেদের তুলে ধরছে। পুলিশ মামলা করছে শুধু বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এবং শত শত অজ্ঞাতনামা আসামি করে। ক্ষমতাসীন দলের ভাষ্যই ফলাও করে বারবার প্রচার করা হচ্ছে অনুগত সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করে। বিরোধীদের বড়ো বড়ো কর্মসূচি ছাড়াও নির্বাচনের আগে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গণহারে আটক করে অজ্ঞাতনামাদের চিহ্নিত করতে পারার দাবি আগেও হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবেÑ এ আশংকা দূর হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নির্বাচনে হয়রানির অভিযোগ উঠলে বলা হবে, ‘সহিংসতার মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।’

যদি দলীয় সরকার বহাল থাকে?

মার্কিন ভিসা নীতিতে তুষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিশ্লেষকদের প্রশ্ন হলো, নির্বাচনের সময় যদি দলীয় সরকার বহাল থাকে তাহলে তার কর্তৃত্ব ও প্রভাব কীভাবে মোকাবেলা করা হবে? দলীয় সরকার ও এমপিদের স্বপদে বহাল রেখে জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ হওয়া অসম্ভব বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বরাবর দৃঢ় কণ্ঠে বলে আসছেন। কেননা গত অন্তত দুটি সংসদ নির্বাচন ও অন্যান্য স্থানীয় নির্বাচনের নির্বাচনী পরিস্থিতি ও বিতর্কিত ফলাফল বর্তমান ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ^াস আদৌ অর্জিত হয়নি।

বর্তমান সংশোধিত সংবিধানের আলোকে নির্বাচন করা মানে বিদ্যমান জাতীয় সংসদ ও তার ৩৫০ জন সংসদ সদস্য, দলীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা এবং বর্তমান এমপি পদ বহাল রেখেই তার অধীনে নির্বাচন করা। আর সেটিই হবে কথিত ‘নির্বাচনকালীন সরকার’। এর ফলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোন নিশ্চয়তা আদৌ না থাকায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিবে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার সর্বতোভাবে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে যাবে।’ যদিও উল্লিখিত ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ সম্পর্কে সংবিধানে কোনপ্রকারের বিধানই নেই। ফলে সংবিধানেরই রেফারেন্স দিয়ে কীসের ভিত্তিতে এই প্রক্রিয়ার কথা বলা হয় তা বিশ্লেষকদের বোধগম্য হয়নি।

‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে’ বলে বক্তব্য দেয়া হয় তাতে মনে হতে পারে যে, সংবিধানে সে ব্যবস্থা হয়তো বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু ভাষ্যকাররা বলছেন, সংবিধান খুঁজে কোথাও নির্বাচনকালীন সরকার গঠন সম্পর্কে কোন অনুচ্ছেদ বা উপ-অনুচ্ছেদ পাওয়া যায়নি। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি অন্তবর্তীকালীন মন্ত্রীসভা গঠন ব্যতিত কোন বিকল্পও দেখা যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন পর্যবেক্ষগণ। রাজনৈতিক মহলের অভিযোগ, মহাজোটের শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে সংবিধানকে ইচ্ছেমত কাটাছেড়া করার পর এখন এই সংবিধানের দোহাই দেয়া হচ্ছে। অথচ সরকার যদি নিজেদের সুবিধার পথ সুগম রাখার জন্য সংবিধানে ব্যাপক রদবদল ঘটাতে পারে তাহলে বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার স্বার্থে সামান্য পরিবর্তন মেনে নিতেই পারে।

এদিকে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি চলে আসছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের নিজ নিজ পদে বহাল রেখেই আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ বর্তমান সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী পরিষদ সদস্যদের আসন শূন্য ঘোষণা না করেই বর্তমান সংবিধানের বিধান অনুযায়ী তিনশ’ আসনে নির্বাচন করতে হবে। আর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে সংসদের মেয়াদ শেষের ৯০ দিন আগে। নতুন সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা আগের সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্বও নিতে পারবেন না।

এমতাবস্থায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা এবং তার পরেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীগণ, প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীগণ স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন, আইন প্রয়োগ করবেন, পুলিশ-র‌্যাবকে হুকুম দেবেন, প্রশাসনে রদবদল করবেন, সমগ্র প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করবেন, উন্নয়ন কাজে অর্থ বরাদ্দ করবেন এবং সেগুলোর উদ্বোধন করবেন, ত্রাণ বিতরণ করবেন ইত্যাদি। প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কাজের অসিলায় তারা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যাবেন, বক্তব্য দেবেন, মিডিয়ায় প্রচারের অগ্রাধিকার পাবেন।

এসব কাজ নিশ্চয়ই সামগ্রিক নির্বাচনী আবহ ও পরিবেশকে প্রভাবিত করবে। সংবিধানের বিধানের জোরেই তারা এসব কাজ অব্যাহত রাখবেন। অন্যকোন বিষয়ই তাদেরকে এ থেকে বিরত রাখতে পারবে না।

Please follow and like us:

Check Also

নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা

চট্টগ্রামে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।