সাতক্ষীরায় ১৫০ কোটি টাকার কুলের বাজার, অনাবাদি জমিতে কুল চাষ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে শত শত কুল চাষি

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ সাতক্ষীরার কুল সারা দেশের নজর কাড়ছে। জলাবদ্ধতা, লবণক্ষতা ও অনাবাদি জমি কঠোর পরিশ্রম আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে শত শত কুল চাষি। অন্য যেকোনো ফসলের চেয়ে স্বল্পসময়ে অধিক মুনাফা পাওয়ায় প্রতি বছর বাড়ছে এর আবাদ। নয় বছরের ব্যবধানে ফলটি ৪৫ শতাংশ আবাদ বেড়েছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এ জেলার উৎপাদিত কুল যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তবে এ বছর ভালো দাম পাচ্ছে কুল চাষিরা। সাড়ে ৫ হাজার পরিবারে২০ হাজারের বেশি নারী ও পুরুষ শ্রমিক কুলবাগানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে, কুল চাষে অধিক লাভবান হওয়ায় কৃষক ঝুঁকে পড়েছে কুল চাষে। এবার জেলার ৮৪১ হেক্টর জমিতে কুল চাষ করা হয়েছে। যা থেকে ১২ হাজার টন কুল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। যার বাজারমূল্য হবে ১৫০ কোটি টাকার ওপরে। এবছর সাতক্ষীরার কুল বরই বিদেশে রফতানির সম্ভবনা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান সংশৃষ্টরা।

জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ অনাবাদি জমি এখন সারি সারি কুল গাছে ছেয়ে গেছে। গাছগুলোতে শোভা পাচ্ছে নানা জাতের কুল। আর কুলের ভারে নুইয়ে পড়ছে ডাল। কিছু বাগান থেকে আগাম জাতের কুল সংগ্রহ শুরু করেছেন কৃষকরা। বর্তমানে জেলার স্থানীয় বাজারগুলোতে মিষ্টি কুল ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর টক কুল বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা থেকে ৮০ টাকা দরে। কয়েকজন কুল চাষি জানান, প্রতি বিঘা জমিতে কুল চাষ করতে খরচ হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। সেখানে বিক্রি করতে পারবেন ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। আর এ বছর ফলন ও বাজার দর ভালো হওয়াতে কুল চাষে ভালো লাভের আশায় রয়েছেন তারা।

সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলার মাটি কুল চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় ২০০০ সালের পর এ জেলায় বাণিজ্যিকভাবে কুল চাষ শুরু হয়। ফসলটি লাভজনক হওয়ায় অন্যান্য ফসলের উৎপাদন কমিয়ে জেলার কৃষকরা তাদের জমিতে বল সুন্দরী, ভারত সুন্দরী, থাই আপেল, বাউ কুল, আপেল কুল, তাইওয়ান কুল, নারিকেলি, ঢাকা নাইনটিসহ বিভিন্ন জাতের কুল চাষ করে আসছেন। ২০১৬ সালে জেলার ৪৯০ হেক্টর জমিতে কুলের আবাদ হয়। তবে নয় বছরে ব্যবধানে ৪৫ শতাংশ জমিতে আবাদ বেড়েছে।

সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অফিস থেকে জানা গেছে, এ বছর ৮৪১ হেক্টর জমিতে কুল চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ১১২ হেক্টর জমিতে, কলারোয়া উপজেলায় ৪৭০ হেক্টর জমিতে, তালা উপজেলায় ১৬৫ হেক্টর জমিতে, দেবহাটা উপজেলায় ৪ হেক্টর জমিতে, কালিগঞ্জ উপজেলায় ৪৫ হেক্টর জমিতে, আশাশুনি উপজেলায় ২০ হেক্টর জমিতে, শ্যামনগর উপজেলায় ২৫ হেক্টরসহ মোট ৪৯০ হেক্টর জমিতে কুলের আবাদ হয়েছে।

সাতক্ষীরার বাউ, নারিকেল, গাব, বিলেতি ও আপেলকুলসহ বিভিন্ন প্রকার কুলের সুনাম রয়েছে দেশ—বিদেশে। বর্তমানে হাইব্রিড এসব কুল বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ শুরু হওয়ায় ও লাভ বেশি হওয়ায় এর চাষ জেলায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। স্বল্প খরচ ও ঝুঁকি কম থাকায় জেলার বেকার যুবসমাজ ও চাষিদের একটি বিরাট অংশ এখন কুল চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কুল চাষ করে এ জেলার অনেকেই তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়ে দূর করেছে বেকারত্ব, সৃষ্টি করেছে নুতন কর্মসংস্থানের।

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খলিষখালি ইউনিয়নের মঙ্গলানন্দকাটি গ্রামের কুল চাষি রবিউল ইসলাম। লেখা পড়া শেখ না করেই কুল চাষে ঝুকে পড়ে। অল্প পুজি ও স্বল্প জমিতে কুল চাষ শুরু করে। প্রথম বছরেই সে লাভের মুখ দেখতে থাকে। এর থেকে সে কুল চাষ বাড়াতে থাকে। বর্তমানে সে প্রায় ১০ বিঘা জমিতে কুল চাষ করেছে। তার দেখা দেখিতে এলাকাতে আরো অনেক বেকার যুবক কুল চাষ করতে শুরু করেছে।
জুজখোলা গ্রামের জামাল উদ্দীন নামে অপর এক কুল চাষি জানান, এবার তিন বিঘা জমিতে বল সুন্দরী, আপেল ও থাই কুল চাষ করেছেন। বর্তমানে প্রতিটি গাছে ৩ থেকে ৪ মণের বেশি কুল ধরেছে। যা ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে শুরু করেছেন। অল্প খরচ ও কম পরিশ্রমে কুল চাষ অধিক লাভজনক। যেকোনো পতিত জমিতে কুল চাষ করা সম্ভব। এজন্য আগামীতে তার বাগান আরও প্রসারিত করবেন।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. জামাল উদ্দিন জানান, স্বল্পসময়ে খুবই লাভজনক কুল চাষ। দ্রুত এর প্রসার ঘটছে। চাষীরা খুবই আগ্রহী হচ্ছেন ফলটি চাষে। তাছাড়া জেলার অনেক মৎস্য ঘেরে কুল চাষ করে লাভবান হচ্ছেন মৎস্য চাষীরাও। তিনি বলেন, ‘অনেক উন্নত জাতের সুস্বাদু কুল চাষ হচ্ছে এ জেলায়। প্রতি টন কমবেশি ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। বছরে ১৮—২০ হাজার টন কুল উৎপাদন হচ্ছে। সে হিসাবে গড় মূল্য ১৫০ কোটি টাকার ওপরে।’
সরকারী পৃষ্টপোষকতা পেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে কুল বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

Check Also

ফিংড়ীতে জামায়াতের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত

হেলাল উদ্দিন,সাতক্ষীরা সদরের ফিংড়ী ইউনিয়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২১ জানুয়ারি মঙ্গলবার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।