# প্রভাবশালীদের দখলে উপকূলের হাজার হাজার হেক্টর জমি #বেড়িবাঁধের নিচে ছিদ্র করে অবৈধ পাইপ লাইন অপসারণে নির্দেশ

আবু সাইদ বিশ^াস, সাতক্ষীরাঃ জাতীয় ও আন্তজার্তিক আইন—নীতির তোয়াক্কা না করে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ, উপকূলীয় বেড়িবাঁধ কেটে বা বাঁধ ফুটো করে পাইপ লাগিয়ে চিংড়ি ঘেরে লোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ করায় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চল। বিত্তবান প্রভাবশালীরা উপকূলের হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমি দখলে নিয়ে চিংড়ি চাষ করছে। এতে করে চরম বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে মানুষের জীবন যাত্রা। প্রতিনিয়ত ভাঙ্গছে উপকূল রক্ষা বাঁধ। বৃহষ্পতিবার জেলার আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট গ্রামের খোলপেটুয়া নদীর ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শনকালে সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের আমীর উপাধ্যক্ষ শহিদুল ইসলাম মুকুল ঘেরে নদীর লবণ পানি উঠাতে বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে অবৈধভাবে পাইপ বসানোর বিষয়টি বিভাগীয় কমিশনারের দৃষ্টিগোচরে আনেন। বিভাগীয় কমিশনার মোঃ ফিরোজ সরকার আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায়কে চিংড়ি ঘেরে লবণ পানি উত্তোলনের জন্য পাউবোর বেড়িবাঁধের নিচে ছিদ্র করে ঘের মালিকদের বসানো অবৈধ পাইপ লাইন অপসারণে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশ দেন। শুক্রুবার ৪ এপ্রিল পাউবো বিভাগ—২ এর আওতাধীন ৭/২ পোল্ডারের বিছট, নয়াখালী, কাকবসিয়াসহ আশপাশের এলাকা থেকে সব পাইন লাইন অপসারণ করে নিয়েছেন বেশ কয়েকজন ঘের মালিক।
উপকূলঘেঁষা চার উপজেলা— সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং খুলনার কয়রা ও পাইকগাছায় সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, কোথাও বেড়িবাঁধ কেটে পানি ঢোকানো হয়েছে চিংড়ি ঘেরে, কোথাও বাঁধ ফুটো করে পাইপ লাগানো হয়েছে, আবার কোথাও বাঁধের দু’ধারে মোটা পাইপ; সঙ্গে নলকূপ লাগানো। বাঁধের একপাশে নদী, অন্যপাশে চিংড়ির ঘের—পশ্চিম উপকূলের বিপন্ন এলাকায় এটা খুবই পরিচিত দৃশ্য।
সূত্রবলছে, উপকূলীয় অঞ্চলে বিপর্যয়ের শুরু সেই ষাটের দশকে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধের পাশাপাশি ভারতের ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ এর অন্যতম কারণ। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। একই বছর ফারাক্কা বাঁধেরও নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সাগরের জোয়ারের সঙ্গে যে পলি ঢুকতো, বাঁধ নির্মাণের আগে পলিমাটি ভাটার টানে নদী দিয়েই আবার নেমে যেত। কিন্তু ফারাক্কার কারণে সাতক্ষীরাসহ খুলনা অঞ্চলের নদ—নদীগুলো পানির অভাবে স্বাভাবিক গতি হারায়। ফলে পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হতে থাকে।একই সময়ে নিয়ন্ত্রণহীন চিংড়ি চাষ শুরু হয়। আশির দশকের শুরুতে আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর ঋণের টাকায় চিংড়ি চাষ শুরু হয়। সে সময় বিদেশি গবেষকেরা উপকূল অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে কৃষকদের বুঝিয়েছেন— চিংড়ি চাষে লাভ বেশি। এভাবে ব্যক্তি উদ্যোগে চিংড়ি চাষ শুরু হলেও এক সময় বড় পরিসরে চলে যায়। সরকারের তৃতীয় ও চতুর্থ মৎস্য প্রকল্পের আওতায় চিংড়ি চাষকে উৎসাহিত করা হয়। চিংড়ি ঘেরের লবণ পানি আনা হয় নদী থেকে। আবার শুকনো মৌসুমে চিংড়ি ঘের পানিমুক্ত করা হয়। সে পানিও নদীতেই ফেলা হয়। এই গোটা ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অলিখিতভাবে বেড়িবাঁধের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় চিংড়ি ঘের মালিকদের হাতে।
জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা ২০১৪—এর ৫.৭৫ ধারায় উল্লেখ রয়েছে: ‘যত্রতত্র পোল্ডারের বেড়িবাঁধ কেটে লোনা পানি প্রবেশ না করিয়ে নির্ধারিত স্থান দিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে লোনা পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ি চাষ করতে হবে। বাঁধের ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মূল নকশা অনুসরণ করতে হবে।’ জাতীয় পানি নীতি ১৯৯৯—এর ৪.১ (ঘ) ধারায় উল্লেখ রয়েছে: ‘বনায়ন ও নদীর ভাঙন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নদী অববাহিকার বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং ভূমি ক্ষয় রোধের জন্য ক্যাচমেন্ট এলাকার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।’ সমন্বিত ক্ষুদ্র সেচ নীতিমালা ২০১৪—এর ৫.৬ (ঘ) ধারায় উল্লেখ রয়েছে: ‘উপকূলীয় এলাকায় বিদ্যমান শতাধিক পোল্ডারের ব্যবস্থাপনা কাঠামোকে ব্যবহার করে সেচ ব্যবস্থায় মিঠা পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।’
বেড়িবাঁধ সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩, উপকূলীয় অঞ্চল পলিসি ২০০৫সহ বিভিন্ন বিধি বিধানে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব বিধি বিধানের যথাযথ প্রয়োগ যে নেই, তার প্রমাণ মেলে অনুসন্ধান চালানো চার উপজেলার চারটি থানা ও সংশ্লিষ্ট আদালতগুলোর রেকর্ড ঘেঁটে। সাতক্ষীরার আশাশুনি থানার রেকর্ড বলছে, বেড়িবাঁধ কাটাছেঁড়ার অপরাধে এই থানায় ৩৬০টি মামলা আছে। কিন্তু মামলাগুলো ফ্রিজ হয়ে আছে। কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় কারো সাজাও হয়নি।
শ্যামনগর থানার রেকর্ড অনুযায়ী, বাঁধ সুরক্ষা আইনে বাঁধ কাটা, পাইপ বসানো, বাঁধ ছিদ্র করা, আউট ড্রেন না রাখাসহ অন্যান্য কারণে এ উপজেলায় আইলার পর থেকে এ পর্যন্ত ৮০০ মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ আছে প্রায় পাঁচশ মামলায়। বাকি মামলার আসামীদের কেউ কেউ ৫—৭ দিন কারাগারে আটক ছিলেন। পরে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। তবে ঘের মালিকেরা কেউ আটক হননি। যারা আটক হয়েছেন, তারা ঘেরের শ্রমিক।
আনুলিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শওকত হোসেন জানান, সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাউবো’র বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে অবৈধভাবে পাইপ ঢুকিয়ে নদীর লবন পানি উঠিয়ে চলছে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক বেড়িবাঁধের ১০০ মিটার দূরে ঘের করার নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ চিংড়ি চাষীরা তা মানছে না। এভাবে যত্রতত্র পাইপ বসানোর কারণে বেড়িবাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে প্রতিবছর ছোটখাটো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ভেঙে যাচ্ছে এসব বেড়িবাঁধ। প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। নোনা পানির বিরূপ প্রভাবে উজার হচ্ছে বনজ ও ফলদ সম্পদ। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ মার্চ সকাল পৌনে ৯টার দিকে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের একটি অংশ ভেঙে প্রায় ১৫০ ফুট জায়গা খোলপেটুয়া নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ভাঙ্গনের স্থানে একটি বিকল্প রিং বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করলেও জোয়ারের পানির চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় তা সম্ভবপর হয়নি।

আবু সাইদ বিশ^াস
সাতক্ষীরা
০৪/০৪/২৫

 

 

Check Also

সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন নগর গড়ে তোলার দাবিতে মানববন্ধন

সাতক্ষীরায় সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন নগর গড়ে তোলার দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার (২০ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।