সোনার বাংলা রিপোর্ট : শোষণমুক্ত, ন্যায় ও ইনসাফের আলোকে এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সাবেক সম্পাদক মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তিনি এ নশ্বর পৃথিবী থেকে চলে গেছেন আজ থেকে ১০ বছর আগে ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল। কিন্তু তিনি এদেশের মানুষের মাঝে বেঁচে আছেন তাঁর কর্মের গুণে। আজ এ দ্বিতীয় স্বাধীন ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশে তিনি নেই। ফ্যাসিস্ট হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ভিত্তিহীন মিথ্যা অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাহী আদেশে ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গাইতে গাইতে কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করে চলে গেছেন মহান রবের সান্নিধ্যে ওপারের সুন্দর জীবনে।
তিনি শুধু একজন সফল সাংবাদিকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করে দক্ষতা ও যোগ্যতার কারণে কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষতার সাথে। সাংবাদিকতা এবং রাজনীতিÑ এ দুইয়ের সমন্বয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে পালন করার মতো সাহসী ও সফল মানুষ খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মাঝে এ দুই গুণের অবস্থান ছিল রীতিমতো ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর জেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদিপাড়া গ্রামে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম ইনসান আলী সরকার ও মাতা মরহুমা সালেহা খাতুন।
তিনি কুমরী কালিতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর শেরপুর জিকেএম ইনস্টিটিউশনে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বরাবরই প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। অষ্টম শ্রেণিতে তিনি আবাসিক বৃত্তি পান। ১৯৬৭ সালে জিকেএম ইনস্টিটিউশন থেকে ৪টি বিষয়ে লেটারসহ এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং আবাসিক বৃত্তি লাভ করেন। পুরো শেরপুরে একজন ভাল ছাত্র হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। এছাড়া তিনি ছাত্রজীবন হতেই একজন বিনয়ী, ভদ্র, অমায়িক মানুষ হিসেবে সর্বজনবিদিত। ১৯৬৭-৬৯ সেশনে জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু দেশে ’৬৯-এর গণআন্দোলন শুরু হওয়ায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। ১৯৭১ (১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত) সালে মোমেনশাহী নাসিরাবাদ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৩ (১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত) সালে ঢাকা আইডিয়াল কলেজ থেকে ডিস্ট্রিংশনসহ বিএ পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবৃত্তি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে কৃতিত্বের সাথে সাংবাদিকতায় এমএ পাস করেন। জননেতা কামারুজ্জামান ১৯৭৭ সালে নুরুন্নাহারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ৫ সন্তানের জনক। তারা হলেনÑ হাসান ইকবাল ওয়ামী, হাসান ইকরাম ওয়ালী, হাসান জামান ওয়াসী, হাসান ইমাম ওয়াফী ও আহমদ হাসান সাফী।
শেরপুরের বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব মরহুম কাজী ফজলুর রহমানের আহ্বানে জিকেএম ইনস্টিটিউটে নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন তিনি ইসলামী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন। কলেজে পা দিয়েই তিনি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি প্রথম ঢাকা মহানগরীর সভাপতি এবং পরে সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন। ১৯৭৮ সালের ১৯ এপ্রিল ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং এক মাস পরই নির্বাচনের মাধ্যমে শেসনের বাকি সময়ের জন্য কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৮-৭৯ সালেও শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন। বিশ্ব মুসলিম যুব সংস্থা (ওয়ামী) এবং বাংলাদেশ সরকারের যুব মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ১৯৭৯ সালে মৌচাক স্কাউট ক্যাম্পে আন্তর্জাতিক ইসলামী যুব সম্মেলন আয়োজন করা হয়। এতে তিনি প্রধান সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় যুব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন শেরপুরের আরেক কৃতিসন্তান মরহুম খন্দকার আব্দুল হামিদ। উল্লেখ্য, এ সম্মেলনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন।
১৯৭৯ সালে মুহাম্মদ কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন, একই বছর তিনি জামায়াতের রুকন (সদস্য) হন। ১৯৮১-৮২ সালে তিনি কিছুদিনের জন্য ঢাকা মহানগরী জামায়াতের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে তাকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর জনগণের অশ্রুসিক্ত ভালোবাসা নিয়ে শেরপুরে নিজের গড়া এতিমখানার পাশে চিরনিন্দ্রায় শায়িত আছেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান।
