জিএম আমিনুল হক: ‘সোনালী শীষের সোনার ধানে মাঠ গিয়েছে ভরে, তাইতো তাদের ধুম পড়েছে ধান তুলিতে ঘরে’। সাতক্ষীরার মাঠে মাঠে কৃষকদের ধান কাটা, মাড়াই ঝাড়াই শেষে ধান ঘরে তোলা ও চাল তৈরি করার জন্য সিদ্ধ করা ও শুকানোর মহোৎসব চলছে। এবছর সাতক্ষীরা জেলায় গতবছরের তূলনায় এবছর ইরি বোরো ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসির ঝিলিক বইছে। তীব্র গরমকে উপেক্ষা করে কৃষক কৃষাণীরা দিনরাত সোনালী শীষের পাকা ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ইরি ধান ঘরে তোলার ভরা মৌসুমে সাতক্ষীরার হাজার হাজার দিনমজুর শ্রমিক ইতোমধ্যে বেশি মজুরিতে কাজ করতে বিভিন্ন জেলায় চলে যাওয়ায় শ্রমিক সংকটের কারণে দ্বিগুন মুজুরি দিয়ে কৃষকদের ধান ঘরে তোলার ধুম পড়েছে। পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরা সমান তালে ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছে। সাতক্ষীরার মূল শ্রমিকের এক তৃতীয়াংশ নারী শ্রমিক পুরুষের পাশাপাশি ধান কাটায় নিয়োজিত। এ বছর সাতক্ষীরা জেলায় ইরি বোরো ধান লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ থেকে ৩০শতাংশ বেশি উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এবছর সরকারি ভাবে ধানের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি ৩৬টাকা। সাতক্ষীরা জেলার মধ্যে চলতি বছর সবচেয়ে বেশি বাম্পার ফলন হয়েছে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায়।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনির হোসেন জানান-সাতক্ষীরা জেলায় এবছর সর্বমোট ৭৯হাজার ৮২০হেক্টর জমিতে ইরি ধান চাষাবাদ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩লাখ ৩৬হাজার ৭৭১মে.টন।এর মধ্যেহাইব্রিড ধান ২৪হাজার ৫৫০ হেক্টর, ফলন-৪.৭৮ = ১লাখ ১৭হাজার ৩৪৯ মে. টন, উফশী- ৫৫হাজার ২৭০ হেক্টর, ফলন- ৩.৯৭=২লাখ ১৯হাজার ৪২২মে. টন মোট= ৩লাখ ৩৬হাজার ৭৭১ মে. টন।
তিনি আরও জানান-সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় এবছর ২৩হজার ৫৮৫হেক্টর জমিতে ইরি ধানের চাষাবাদ করা হয়েছে। উৎপাদিত ধান থেকে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৭হাজার ২৭৭মে. টন। সাতক্ষীরায় ইরি বোরো ধানের বাম্পার ফলনে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০-৩০শতাংশ ধান বেশি উৎপাদন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। অনুকূল আবহাওয়া ও কৃষি অফিসের নিরবিচ্ছিন্ন তদারকি, পরামর্শ ও সেবার কারণেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চলতি বছর বেশি ইরিধান উৎপাদনের সম্ভাবনা আছে। যদিও শেষ মুহূর্তে কালবৈশাখীর হানার কারণে বেশ কিছু কৃষকের জমির ধান আংশিক নষ্ট হয়ে গেছে। তা না হলে আরও বেশি ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা ছিল।
ধুলিহর ইউনিয়নের বালুইগাছা গ্রামের ইমরান হোসেন জানান- আমি এবছর ৯ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। বিঘা প্রতি ২৭ মন ধান উৎপাদন হয়েছে। বৃষ্টির আগেই আমার ধান ঘরে তোলা হয়েছে এবং ২২শত টাকা দরে বস্তা বিক্রি করে দিয়েছি।
ভালুকা চাঁদ পুর গ্রামের আদর্শ কৃষক এম এ মাজেদ ডাবলু জানান-আমি ৩বিঘা জমিতে ইরি বোরো ধান চাষ করেছি। বাম্পার ফলন হয়েছে। আমার ধান ঘরে তোলার শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে। সদর ফিংড়ী ইউনিয়নের ফয়জুল্যাপুর গ্রামের আর্দশ কৃষক ও সাবেক মেম্বার শফিকুল ইসলাম জানান,তিনি এ বছর ১৬ বিঘা জমিতে ইরি ধান চাষ করেছে। তার ১৬বিঘাতে জমিতে চাষাবাদে খরচ হয়েছে ১লাখ টাকা। তার বিঘা প্রতি ২৮/২৯মণ ধান উৎপাদন হয়েছে।
সদর বালিথা গ্রামের সাংবাদিক ও ইউপি সদস্য আরশাদ আলী জানান, তিনি ৫বিঘা জমিতে ইরি ধান চাষ করেছেন। ইতোমধ্যে তিনি ধান ঘরে তুলেছেন। ৫বিঘা জমিতে ১৪০মণ ধান উৎপাদন করেছে।
দেবহাটার পারুলিয়ার কৃষক আব্দুর রাজ্জাক জানান, অনেক গরমে ধান কাটতে হচ্ছে। শ্রমিকদের বেশি মুজুরি দিয়ে ধান কাটছি। পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরা ধান কাটছে। গত বছরের তূলনায় এ বছর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
কালিগঞ্জের কৃষক আমিনুর রহমান জানান, ৩বিঘা জমিতে ইরিধান চাষ করেছি। গত বছরের তূলনায় বাম্পার ফলন হয়েছে। ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছি। তীব্র গরমে অনেক শ্রমিকরা ধান কাটতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তিনি বিঘা প্রতি ২৬থেকে ২৮মণ ধান উৎপাদন হবে বলে জানান।
কলারোয়ার কৃষক জব্বার গাজী বলেন, চলতি বছর ইরি বোরো ধানের ফলন বাম্পার হয়েছে। কিন্তু তীব্র গরমে শ্রমিক সংকট দেখা গেছে। সাতক্ষীরার শ্রমিকরা জেলায় বাইরে গিয়ে মুজুরি বেশি নিয়ে ধান কাটছে। সে কারণে সাতক্ষীরার শ্রমিকদের বেশি মুজুরি দিয়ে ধান কাটা লাগছে।
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ইতোমধ্যে ৪০থেকে ৫০শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে এবং ৩০থেকে ৩৫শতাংশ জমির ধান কৃষকের ঘরে উঠে গেছে। আবহাওয়া এবং সার্বিক পরিবেশ অনুকূলে থাকলে আগামী ১০থেকে ১২দিনের মধ্যে সব ধান কৃষকের কাটা মাড়ায় শেষ করে ঘরে তোলার কাজ শেষ হবে বলে একাধিক কৃষকরা জানিয়েছেন। তবে এবছর তীব্র তাপ প্রবাহের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টি হওয়ার কারণে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তবে কষ্ট করে হলেও কৃষকরা দ্রুত ধান ঘরে তোলার প্রতিযোগিতা চলছে বলে তারা জানান। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ তাপ প্রবাহের মধ্যেও কৃষকরা দৈনিক ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করছেন বলে একাধিক শ্রমিকরা জানিয়েছেন। তবে একাধিক দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিকরা জানান-এখন ধান কাটার ভরা মৌসুম চলছে। তাই দৈনিক ১৬/১৮ ঘন্টা কাজ করছি এবং মজুরি হিসেবে ১থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। তীব্র গরমে সারা দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকরা অসহনীয় কষ্টের মধ্যেও তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ধুমধাম করে ঘরে ধান তোলার জন্য ব্যস্থ সময় পার করছেন বলে একাধিক কৃষকরা এ প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন।
