ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা
আবু সাইদ বিশ^াস, সাতক্ষীরা: জলবায়ু পরিবর্তনে চরম হুমকির মুখে পড়েছে উপকুলীয় অঞ্চলের ইকো—সিস্টেম ব্যবস্থপনা। সেই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে তাদের জীবন ও জীবিকা। লবণাক্ততার কারণে কৃষক তার জমিতে ফসল ফলাতে পারছেন না, হালের পশু ও অন্যান্য গৃহপালিত পশুর খাদ্যের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে। চাষযোগ্য জমি হারাচ্ছে তার ঊর্বরতা। এছাড়া প্রতিনিয়ত এই অঞ্চলের মানুষকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে স্বাস্থ্যজনিত বিভিন্ন সমস্যা । জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জেলার ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬২৬ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে ৮১ শতাংশেরও বেশি জমি অর্থাৎ ১লাখ ৫৩ হাজার ১১০ হেক্টর জমি লবণাক্ততায় রূপ নিয়েছে। উদ্বেগজনক হারে বনভূমি কমে যাওয়ায় পাখিদের অভয়ারণ্য কমে এসেছে। একই সঙ্গে কমে গেছে বন্যপ্রাণীদের চারণ ও বাসভূমি। ইতোমধ্যে প্রায় ২শ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অস্তিত্বের সঙ্কটে রয়েছে প্রায় ৩ শতাধিক প্রজাতির পাখি, সরীসৃপ ও জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড়। জলজ প্রাণীর সংখ্যাও নেমে এসেছে প্রায় শুন্যের কোটায়। ফলে, নষ্ট হচ্ছে এই অঞ্চলের পরিবেশের ভারসাম্য।
ভৌগোলিকভাবেই বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে বঙ্গোপসাগর যেটা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টিতে সহায়ক একটি জায়গা। আর জায়গাটির আকার অনেকটা ফানেল আকৃতি হওয়ার কারণে দক্ষিণা বাতাস উপকূলে এসে বিভিন্ন দুর্যোগ সৃষ্টির সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে। সাধারণত ঘূর্ণিঝড় তৈরিতে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় যা বঙ্গোপসাগরে বিরাজ করে। বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে ব্যাপক হারে। প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। কেননা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোই ঘূর্ণিঝড়ে বেশি আক্রান্ত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকতে ও দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রয়োজন পরিকল্পিত বনায়ন প্রকল্প। পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, দেশের মোট জমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। তা না তাহলে সেখানকার পরিবেশ ভারসাম্যহীন অবস্থায় থাকবে। অথচ উপকূলীয় অঞ্চলে বনভূমির পরিমান উদ্বেগ হারে হ্রাস পাচ্ছে।
শুক্রবার (২৩ মে) বেলা ১২টায় শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সম্মেলন কক্ষে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলীয় সামাজিক বনায়ন ও ইকো—সিস্টেম ব্যবস্থপনা ও পুনরুদ্ধার বিষয়ক উপজেলা পর্যায়ে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়েছে। “ব্লু—ইকোনমি এ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস” প্রকল্প আওতায় ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স, কোডেক এবং বেলা, অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশ এর আয়োজন করে। ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের পরিচালক (কর্মসুচি ও পরিকল্পনা) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম ইসলামের সভাপতিত্বে ‘অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খুলনার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) হুসাইন শওকত। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছাঃ রনী খাতুন, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল রিফাত।
অনুষ্ঠানে বক্তরা বলেন, বাংলাদেশ ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর অন্তর্গত একটি দেশ। ফলে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবেও প্রতি বছর ঝড়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জানমালের ক্ষতির পাশাপাশি সে সময়ে অন্যান্য ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় এ দেশের জনগণকে। আর এসবের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে পরিকল্পিত সবুজায়নের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সবুজায়ন কেবল কার্বন নিঃসরণ হ্রাসকরণে কার্যকর তা—ই নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়ও এ সবুজ বনায়ন কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
প্রতিবছরই ছোট—বড় মিলিয়ে তিন—চারটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দেয় সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায়। এতে জেলার উপকূলবর্তী তিন উপজেলা শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও আশাশুনি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বছরের বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট নদীভাঙনে গত কয়েক বছরে সহস্রাধিক ঘরবাড়ি, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বহু কৃষিজমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে ওই তিন উপজেলার অধিকাংশ গ্রাম। এতে সহায়—সম্বল হারিয়ে বাসস্থান ছেড়েছেন অনেক মানুষ।
উপকূলের বাসিন্দারা বলছেন, উপকূলের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রার উন্নয়নে এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তন—সম্পর্কিত বিষয়ে সাতক্ষীরার দুটি উপকূলীয় উপজেলা নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা লিডার্স। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার তিন লক্ষাধিক মানুষ বছরের প্রায় সাত মাস দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইটভাটায় অবস্থান করেন। আর এ সময় ওই সব পরিবারের শিশু সন্তানরা শিক্ষা থেকে পিছিয়ে যায়। জড়িয়ে পড়ে শিশুশ্রমে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য ও পুষ্টির অভাব শিশুদের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, প্রতি লিটার পানিতে শূন্য থেকে ১ হাজার মিলিগ্রাম লবণ থাকলে সে পানি পানযোগ্য। কিন্তু উপকূলে প্রতি লিটার পানিতে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার মিলিগ্রাম লবণ রয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ মানুষ খাওয়ার পানির সংকটে রয়েছেন বলে জানানো হলেও বাস্তবে এই চিত্র আরও ভয়াবহ।