আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষীরা: ঘূর্ণিঝড় শক্তির আঘাতের শঙ্কায় আতংকিত হয়ে পড়েছেন সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। বিরাজ করছে আতঙ্ক। নতুন ঘূর্ণিঝড় শক্তির পূর্বাভাস উপকূলবাসীকে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে দুর্বল বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্কে উপকূলবর্তী মানুষ। বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ চললেও বেশ কিছু স্থান এখনো রয়েছে অরক্ষিত। সংশ্লিষ্ট বলছে, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার প্রায় ১৪৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২০ কিলোমিটার জরাজীর্ণ ও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। অন্তত ২৭টি পয়েন্ট অতি ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে দুর্বল বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলবাসীর ভরসারস্থল বেড়িবাঁধ। সেই বেড়িবাঁধ দূর্বল থাকায় উপকূলবাসীর মনে শঙ্কা বাড়ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ সময় মতো মেরামতের উদ্যোগ নিলে কম খরচ ও কম সময়ের মধ্যে মানসম্মত কাজ করা সম্ভব। কিন্তু বর্ষার আগমুহূর্তে নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লে পাউবো কর্তৃপক্ষ বাঁধ মেরামতের উদ্যোগ নেয়। এতে একদিকে খরচ বাড়ে, অন্যদিকে তড়িঘড়িতে কাজ হয় নিম্নমানের। ফলে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকার ঝুঁকি কমছে না, বরং বাড়ছে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় শক্তি ২৮ থেকে ৩০ মে দুপুর নাগাদ বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ঘূর্ণিঝড় উপকূলের দিকে এগিয়ে আসার পাশাপাশি উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় শনিবার বেলা ১০টা থেকে থেমে থেমে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন রয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছে, এই মে মাসে সুন্দরবন উপকূলে আছড়ে পড়েছিল আইলা, ফণী, বুলবুল, ইয়াস, আম্পান, রোমেল এর মতো প্রলয়ংকরী সব ঘূর্ণিঝড়। এর মধ্যে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণী, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালে ২৬ মে ইয়াস, ২০২২ সালের ১২ মে অশনি এবং ২০২৩ সালের ১৪ মে মোখা আঘাত হানে। এসব ঘূর্নিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রাবিত হয় উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ। তাই উপকূলীয় এলাকার সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
এছাড়া আজ থেকে ঠিক ১৬ বছর আগে ২০০৯ সালের ২৫ মে দেশের দক্ষিণ—পশ্চিম উপকূলীয় জনপদে আঘাত হেনেছিল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। এতে মুহূর্তেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা। ভেসে যায় বহু কাঁচা—পাকা ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত ও মাছের ঘের, প্রাণ হারায় শিশুসহ ৭৩ জন নারী—পুরুষ। মারা যায় হাজারো গবাদি পশু। তবে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’র আঘাতের ১৬ বছর পরও দেশের দক্ষিণ—পশ্চিম উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি আজও। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পসহ বেশ কিছু প্রকল্প নেওয়া হলেও সেসবের বাস্তবায়নকাজ চলছে ধীরগতিতে। ফলে এ অঞ্চলে দুর্যোগের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এরপর এখন উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আঘাতের আশঙ্কায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
উপকূলের বাসিন্দা আশাশুনির বিছট গ্রামের আব্দুল হাকিম মোড়ল জানান, পাউবো বিভাগ—২ এর আওতাধীন ৭/২ পোল্ডারের বিছট সরকারি প্রাইমারী স্কুল থেকে বিছট খেয়াঘাট পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ খুই ঝুকিপূর্ণ। গত ৩১ মার্চ ঈদের দিন সকালে স্কুলের কিছুট দূরে বেড়িবাঁধ ভেঙে আনুলিয়া ইউনিয়নের ৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়। বর্তমানে বিছট গাজী বাড়ি, সরদার বাড়ি ও মোড়ল বাড়ির সামনের বেড়িবাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ এই তিনটি পয়েন্টে মেরামতের কাজ শুরু হলেও দীর্ঘদিন ধরে তা বন্ধ রয়েছে। ফলে এই তিনটি পয়েন্টে বাঁধের অবস্থা খুবই নাজুক।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. রনী খাতুন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পাউবো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া উপজেলা প্রশাসন সার্বিক বিষয়ে তদারকি করছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগের আওতাধীন জেলায় ৬৭৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ২১টি পয়েন্টের ৩৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে পাউবো বিভাগ—১এর অধীনে ৬ টি পয়েন্টে ৩ কিলোমিটার ও বিভাগ—২ এর অধীনে ১৫টি পয়েন্টে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। ঘূর্ণিঝড় যদি সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত নাও হানে, তবুও এর প্রভাবে নদনদীতে পানির চাপ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। আর পানি বাড়লে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার ভয় আছে।
সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ—১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দীন জানান, আমার বিভাগের আওতাধীন ৩৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি পয়েন্টে ৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ এসব বেড়িবাঁধের মেরামতের কাজ চলমান রয়েছে। সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ—২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুর রহমান তাজকিয়া বলেন, আমার বিভাগের আওতাধীন প্রায় সাতক্ষীরা জেলায় ২৯৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৪,৬, ৭/১, ৭/২ ও ৮ এই ৫টি পোল্ডারের ১৫টি পয়েন্টে ৩০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ এই ১৫টি পয়েন্টে ঠিকাদার নিয়োগ করা রয়েছে।
আবু সাইদ বিশ^াস
সাতক্ষীরা
২৫/৫/২৫