জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব উপকূলীয় জনজীবনে ফেলছে গভীর ছাপ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন কিংবা লবণাক্ততার প্রকোপে ধ্বংস হচ্ছে চাষযোগ্য জমি। প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষকরা। বিশেষ করে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা হয়ে পড়েছে উচ্চমাত্রার লবণাক্ত। বহু জমি পরিণত হয়েছে পতিতভূমিতে। তবে এই বিপর্যয়ের মধ্যেই কৃষকদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে লবণসহিষ্ণু ধানের নতুন জাত- বিনাধান-১০।
এই ধান উদ্ভাবনে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। তাদের গবেষণার ফসল আজ বাস্তবের মাঠে কৃষকের ঘরে এনে দিচ্ছে সোনার ফসল। বিনা তাদের জন্য তৈরি করেছেন উদ্ভাবিত লবণসহিষ্ণু কয়েকটি জাতের ধান। এই ধানের চাষ করে এলাকার কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে।
লবণকে জয় করে সাফল্যের পথে উপকূলের কৃষক
স্থানীয় কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলার মধ্যে পাঁচটিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ। তবে এখন এই এলাকায় পতিত জমিতেও ফলছে ধান। উচ্চমাত্রার লবণসহিষ্ণু ধান বিনাধান-৮ ও বিনাধান-১০ চাষে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। এই ধানের চাষে একদিকে যেমন পূর্বে পতিত থাকা জমিগুলো ফিরে পাচ্ছে প্রাণ, অন্যদিকে কৃষকরা পাচ্ছেন আর্থিক স্বস্তি। সহিষ্ণু ধানের জাত বিনা-৮, ১০ ধানের আবাদে ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে।

কৃষকদের অভিজ্ঞতায় ফুটে উঠছে বাস্তব সাফল্য
আশাশুনির আনুলিয়া ইউনিয়নের কৃষক মকবুল মিয়া। পৈতৃকভাবে জমি ৮ বিঘা থাকলেও পুরো জমিতেই ঘের করতেন। ঘেরে আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে মাছ চাষ ছেড়ে দিয়ে ধান রোপনে আগ্রহী হয়েছিলেন তিনি। মকবুল মিয়া বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘খোলপেটুয়া নদী সংলগ্ন সব জায়গায় নোনা পানি। এখানে সবাই অপরিকল্পিতভাবে লবণপানি তুলে মাছচাষ করেন বেশির ভাগই কৃষকরা। এছাড়া এবছরর খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ উপকূলীয় ৮টি এলাকায় লবণপানি প্রবেশ করে। এতে আমাদের ইউনিয়নের অধিকাংশ ফসলি জমিতে লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ে। তবে এখন নতুন করে কিছু এলাকায় লবণ সহনশীল জাতের ধানের চাষ হচ্ছে। ফলনও ভালো। সেখানে আমরা লবন সহিষ্ণু ধান জাত বিনা-১০ রোপণ করে হাসি দেখছি।’
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গ্রামের কৃষক মাজেদ আলীও একই কথা শোনালেন, ‘আমাদের এলাকার অধিকাংশ জমি উচ্চমাত্রায় লবণাক্ত। এখানকার বেশিরভাগ জমিতে লবণপানি তুলে চিংড়ি চাষ করা হয়। প্রায় ২০ বছর পর আমি টানা ৫ বছর মাছের ঘের শুকিয়ে লবণসহিষ্ণু বিনা-১০ জাতের ধানচাষ করেছি। আশা করছি বিঘাপ্রতি ১৭ থেকে ১৮ মণ ধান পাবো। দিন শেষে হিসাব করে দেখা গেছে মাছের চেয়ে ধানে ভালো লাভবান হচ্ছি।’
আটুলিয়া গ্রামের কৃষাণী মাসুমা বেগমের মুখেও হাসি। স্বামী পঙ্গুত্ব হওয়ায় মাঠের সব কাজ করেন তিনি। ছেলে মেয়ে লালন পালন থেকে শুরু করে মাঠে ঘাটে সব কাজেই তারই সমান অবদান। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলছিলেন, ‘এই মৌসুমে ২০ বিঘা জমিতে লবণসহিষ্ণু জাতের ধান আবাদ করেছি। গত মৌসুমে এ জাতের ধান চাষ করে বিঘা প্রতি ১৭ থেকে ১৮ মণ পর্যন্ত ফসল পেয়েছিলাম। দিনশেষে দেখা যাচ্ছে আমাদের এলাকার বেশিরভাগই কৃষক এখন মাছচাষের পাশাপাশি লবন সহিষ্ণু জাতের ধান চাষ করে লাভবান হচ্ছে।’
এ জাতের ধান আলোক-অসংবেদনশীল হওয়ায় আমন ও বোরো উভয় মৌসুমেই চাষযোগ্য। এটি ঝরে পড়ে না, ফলে চাষিদের জন্য এটি একটি নিরাপদ জাত।
বীজ কোথায় পাবেন কৃষকরা?
বিনা উপকেন্দ্র সাতক্ষীরার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মশিউর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিনা, ব্রি, বাড়ি, কৃষি অফিসে ও যোগাযোগ করলে বীজ পেয়ে যাবেন। এছাড়া বিনা এবং কৃষি অধিদপ্তরের কিছু বীজ উদ্যোগতা তৈরি করা আছে প্রান্তিক পর্যায়ে। তাদের কাছ থেকে এই বীজগুলো ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যন্ত তাদের থেকে ও কৃষকরা পাবেন। তাছাড়া বিআরডিসি বীজ উৎপাদন করে থাকেন লোকাল মার্কেটে সেখানে ও আপনারা আমাদের জাতের নাম বলতে পারলে লোকাল মার্কেটে কৃষকরা পাবেন। তাছাড়া ও যদি সরাসরি আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিনা-তে বীজের নেওয়ার জন্য আসেন তবে আমরা প্রথম বছরট তাদের বীজ দিয়ে সহায়তা করতে পারবো।’

সহযোগিতার হাত বাড়াল প্রশাসনও
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ সাইফুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘এই মৌসুমে জেলায় প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে উচ্চমাত্রার লবণসহিষ্ণু জাতের ধানের আবাদ হয়েছে। এবছর তালা, আশাশুনি, দেবহাটা, কালিগঞ্জ, শ্যামনগরের বেশিরভাগই কৃষকেরা লবন সহিষ্ণু ধানের চাষ করে লাভবান হয়েছেন। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকরা লবণসহিষ্ণু জাতের ধানচাষে আগ্রহী হচ্ছেন। জেলা কৃষি বিভাগ এবং বিনা ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা আমরা সব সময় করে থাকছি।’
সবুজে ফিরছে উপকূল
বিনার তথ্য মতে, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পাইকগাছা, দাকোপ অঞ্চলে ৮ থেকে ১৪ টিডিএস মাত্রার লবণাক্ততা রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ জমিতে বিনাধান-১০ এর চাষ হচ্ছে। বিনার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উপকেন্দ্র সাতক্ষীরার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মশিউর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকা সাতক্ষীরা বাগেরহাট, খুলনা, মংলা, পাইকগাছা, কয়রা, দাকোপ এসব এলাকার বেশিরভাগ জমিতে ৮ থেকে ১৪ টিডিএস মাত্রা পর্যন্ত লবণাক্ততা রয়েছে। এর প্রায় ৩০ শতাংশ জমিতে লবণাক্ত সহনশীল বিনা-১০ জাতের ধানের চাষ হচ্ছে। বিনা-১০ ধান ১২-১৪ ডিএস মাত্রার লবণ সহ্য করতে পারে। আশা করছি আগামীতে এই অঞ্চলে ধানের চাষ আরও বাড়বে। একদিন উপকূল সবুজে সবুজে ভরে উঠবে। লবণ নয়, মাঠে থাকবে ধানের হাসি।’
লবণের বিরুদ্ধে লড়াইটা এখন আর একতরফা নয়। গবেষণা ও প্রযুক্তির সংযোগে কৃষকের ঘরে ফিরছে সম্ভাবনা। উপকূলের জমিগুলো আবারও ধানের সোনালি মাঠে পরিণত হচ্ছে। লবণসহিষ্ণু ধানের মতো উদ্ভাবন শেখায়-প্রকৃতির চ্যালেঞ্জ জয় করা সম্ভব, যদি থাকে মাটি ও মানুষের আন্তরিকতার সংযোগ।