ঈদুল আজহার অর্থনৈতিক প্রভাব

ড. ইকবাল কবীর মোহন

বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। এখানকার প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ মুসলিম। বছরে মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। এই দুই ঈদ ঘিরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করা যায়। দুই ঈদকে ঘিরে পোশাক তৈরি ও বিক্রি, পোশাক আমদানি, মশলাপাতি আমদানি ও বিক্রি, চাকরিজীবীদের বোনাস প্রাপ্তি, কুরবানির গরু-ছাগল, মহিষ ভেড়া ইত্যাদির ব্যাপক চাহিদা এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। দেশী শিল্পের পাশাপাশি কৃষিজাত পণ্যের উপাদানের ক্রয়-বিক্রয় বগুগুণ বৃদ্ধি পায। এতে দেশের অর্থনীতিতে সঞ্চারিত হয় গতিশীলতা, কর্মতৎপরতা ও প্রাণচাঞ্চল্য। বিশেষ করে ঈদুল ফিতরের চেয়ে ঈদুল আযহায় দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও তৎপরতা অনেক বেড়ে যায়। তাই ঈদ উৎসব এবং দেশের অর্থনীতি ওৎপ্রোতভাবে জড়িত।

কুরবানির পশুর বাজার ও এর সাথে ব্যবসায় জড়িত কর্মকাণ্ড : ঈদুল আযহা উপলক্ষে পশু লালন-পালন, কুরবানির পশু বিক্রি দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে। এ সময় অর্থনীতিতে ব্যাপক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। বেড়ে যায় গবাদি পশু পালন ও বিক্রি। আগেরকার তুলনায় দেশের মানুষের কুরবানি দেয়ার সামর্থ্য বেড়ে যাওয়ায় গুরু-ছাগল, মহিষ ভেড়া ইত্যাদির বিক্রি অনেক বেড়েছে। ফলে গবাদি পশু পালনের তৎপরতাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালের এক হিসাব অনুযায়ী গরু ও খাসি কুরবানি হয়েছিল আটাত্তর লাখ আট’শ বারোটি। তা ছাড়া মহিষ ও ভেড়া মিলে বিক্রি এই সংখ্যা আরও বেশি। উল্লেখ্য, কুরবানির ঈদ উদযাপন উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি লেনেদেন হয় পশুর বাজারে। এক হিসেব মতে, ২০২৪ সালে সারাদেশে কুরবানির পশুর বাজারে লেনদেন হয়েছে ষাট হাজার কোটি টাকার। কুরবানিকৃত পশুর সরবরাহ ও বেচাকেনার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চাদা, টোল, বখশিস, চোরাকারবার, ফড়িয়া, দালাল, হাশিল, পশুর হাট ইজারা, রশি, বাশ ও খুটির ব্যবসা, পশুর খাবার ও পশু কুরবানি ও বানানো এমনকি পশুর সাজগোজের জন্য বিপুল আর্থিক লেনদেন হয়। ফলে অর্থনীতিতে আর্থিক লেনদেন ও মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়। তা ছাড়া কুরবানিকৃত পশুর চামড়া বেচাকেনা, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য প্রচুর আর্থিক লেনদেন হয়। পশুর চামড়া রপ্তানি বাণিজ্যে, পাদুকা শিল্প এবং হস্তশিল্পেও ব্যাপক আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে। এক তথ্য মতে, দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে সতেরো লাখ ছোট-বড় খামার আছে। এর সঙ্গে প্রায় কোটি মানুষ জড়িত। এরা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করে। এ সময় চামড়া শিল্পে ব্যাংক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। কুরবানির ঈদে পশুর চামড়া সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণ করার সঙ্গে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। এ সময় চামড়া শিল্পে সরকারি ব্যাংকগুলো প্রায় পাঁচ’শ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে থাকে। এতে ব্যাংকের আয় যেমন বাড়ে, তেমনি চামড়া শিল্পের আয়-উন্নতিও বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া এই শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। লবণ চামড়া শিল্পে চামড়া সংরক্ষণের একটি অন্যতম উপাদান। এ জন্য দেশীয় শিল্পে লবণ উৎপাদন এবং চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রয়োজনে আমদানিও বেড়ে যায়। এক হিসেব মতে, গত বছর সরকারকে শুল্কমুক্তভাবে প্রায় চল্লিশ হাজার টন লবণ আমদানি করতে হয়েছে। এর ফলে ব্যবসায়ী, লবণশিল্প এবং পাদুকা শিল্পের আর্থিক তৎপরতা ও কর্মকাণ্ড অনেক বেড়েছে। ঈদ উপলক্ষে প্রতি বছর ফ্রিজের বিক্রি বেড়ে যায়। কুরবানির ঈদকে সমানে রেখে তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকার ফ্রিজ বিক্রি হয় বলে জানা যায়। ফলে এই শিল্পের উৎপাদন ও তৎপরতা অনেক বেড়ে যায়, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

কুরবানির মাংস প্রাণীজ আমিষের উৎস : ঈদুল আযহা উপলক্ষে সারা দেশে পশু কুরবানির ফলে কুরবানিদাতা, তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং সমাজের ব্যাপক গরিব, দুঃখী ও অভাবী মানুষের মধ্যে আমিষের সরবরাহ বেড়ে যায়। অনেক কুরবানিদাতা সারা বছর এই মাংস সংরক্ষণ করে আমিষের চাহিদা পূরণ করেন। কুরবানির সময় সকল কুরবানিদাতা তার কুরবানিকৃত পশুর একটি অংশ বাধ্যতামূলকভাবে সমাজের গরিব-অভাবি মানুষের মধ্যে বিতরণ করে। ফলে যারা সারা বছর প্রাণীজ আমিষের অভাবে ভুগত, তারাও কুরবানির মাংস পেয়ে কিছুদিন সেই চাহিদা পূরণ করতে পারে। ফলে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এই সময়ে সবার মধ্যে প্রাণীজ আমিষের সরবরাহ বেড়ে যায়। মশলা, পেঁয়াজ, রসুন ও অন্যান্য পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হয়: কুরবানির সময় ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার ঘরে ঘরে কুরবানির মাংস রান্নার হিরিক পড়ে যায়। সেদিন দুপুরবেলায় মানুষ পরম আনন্দে সতেজ মাংস রান্না করে তৃপ্তিসহকারে খেতে বসে। আমাদের দেশে খাবার সুস্বাদু করার জন্য মাংস রান্নার কাজে মানুষ হরেক রকম মশলা ব্যবহার করে। গরম মশলা বিশেষ করে এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা, তেজপাতা কুরবানির সময় উল্লেখযোগ্য হারে ব্যবহৃত হয়। এসব পণ্য অনেকগুলো আমদানি করতে হয়। এসব পণ্য কুরবানির বাজারে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এই হিসাবের বাইরেও ঈদের আগে চোরাপথে মায়নমার ও ভারত থেকে প্রচুর মশলা আসে। এর ফলেও অর্থের লেনলেন অনেক বেড়ে যায়। রান্নার কাজে ব্যবহৃত বড় একটি উপাদান পেঁয়াজ। প্রতি বছর দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বাইশ লাখ টন। রসূন ও আদার চাহিদা যথাক্রমে পাঁচ লাখ ও তিন লাখ টন। কুরবানির সময় এসব পণ্যের ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। ফলে চাহিদাও বেড়ে যায়। কুরবানির সময় ছুরি, বটি, দা, চাপাতি, কুড়াল, রামদা, কাঠের গুড়ি, চাটাই, পলিব্যগ ইত্যাদি ছাড়া কুরবানির পশু জবাই, কাটাকাটি সম্ভবই হয় না। এর পেছনে খরচের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেই অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কুরবানিতে পণ্যগুলোর বাজার প্রায় এক হাজার কোটিরও বেশি।

হজ পালনে প্রচুর আর্থিক লেনদেন : ঈদুল আযহা উপলক্ষে হজ পালনের প্রস্তুতি, যাতায়াত, আবাসন ব্যবস্থাপনা এবং সৌদিআরবে জীবননির্বাহের জন্য যে খরচ করে তা অর্থনীতিতে একটি বিশেষ অবদান রাখে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে এক লাখ দশ হাজার পাঁচশত ছিয়াত্তর জন মুসলিম হজ পালন করেন। প্রতি জনে গড়ে পাঁচ লাখ টাকা ব্যায় নির্বাহ করলে এই খাতে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া হজের ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাংলাদেশি এবং বিদেশী মুদ্রা ব্যয়ের সংযোগ রয়েছে। এর ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে সেবা এবং লেনদেন বেড়ে যায়। দেশের হজ ও টিকিট অ্যাজেন্সিগুলোর আর্থিক ও ব্যবসায়িক তৎপরতা অনেক বেড়ে যায় এবং সার্বিক অর্থনীতিতে হজের কর্মকাণ্ড গতিশীলতা আনয়ন করে।

পরিবহন খাতে গতি আনে ঈদ : আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঈদের সময় ঈদ উপলক্ষে বোনাস প্রদান করা হয়। এক হিসেব মতে, দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারির মধ্যে বোনাস বিতরণ করা হয় প্রায় পনেরো হাজার কোটি টাকা।

দেশব্যাপী ষাট লাখ দোকান কর্মচারিদের বেনাস আসে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। পোশাক ও বস্ত্রখাতের সত্তর লাখ শ্রমিকের সম্ভাব্য বোনাস তিন হাজার পাঁচশত কোটি টাকা। তা ছাড়া আছে বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারির বোনাস। সবমিলে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঈদ উপলক্ষে অর্থনীতিতে বাড়তি যোগ হয়। ফলে অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায়। এই অর্থ কিন্তু বসে থাকে না। বরং তা বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যেও গতিকে প্রভাবিত করে। তখন মানুষ জামা-কাপড়, জুতা, প্রশাধনী, আতর ও জায়নামাজ ইত্যাদিসহ নানা খাতে যেমন অর্থ ব্যয় করে. তেমনি গরিব-দুঃখী ও অভাবি মানুষকে দান করার ফলে অর্থনীতিতে অসাধারণ প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়। এ সময় দেশে অধিকাংশ শহুরে মানুষ মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের সাথে ঈদ উদযাপন করার জন্য গ্রামের বাড়িতে ছুটে যায়। ফলে ট্রেন, বাস মালিক সবার ব্যবসায় গতি আসে। এতে কুরবানির সময় পরিবহন খাতে যে বাড়তি চাপ তৈরি হয়, তাতে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যবসা ও লেনদেন হয়ে থাকে। এই কর্মকাণ্ডের ফলে অর্থনীতিতে চাকা গতি লাভ করে।

বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করে : কুরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে প্রবাসী রেমিট্যান্সের প্রবাহ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। প্রবাসীরা তাদের পরিবার-পরিজনের নানাবিধ ঈদ খরচ ও কুরবানির জন্য প্রচুর বিদেশী মুদ্রা পাঠিয়ে থাকে। এতে অর্থনীতিতে লেনদেন বেড়ে যায় এবং জাতীয় অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আগের বছর ঈদের আগের মাস অর্থাৎ মে মাসে যেখানে রেমিট্যান্স আসে ২.২৫ বিলিয়র ডলার। অথচ একই বছর জুন মাসে ১৬-১৭ তারিখ ঈদুল আযহা পালিত হওয়ার কারণে জুন মাসে মোট রেমিট্যান্স আসে ২.৫৩ বিলিয়ন ডলার। এখানে উল্লেখ্য, ঈদ যেহেতু জুনের মাঝামাঝি সময়ে হয়েছে, রেমিট্যান্সের একটা অংশ মে মাসেই দেশে প্রবেশ করে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪ সালে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ নতুন রেকর্ড করেছে। পুরো বছরে মোট রেমিট্যন্স আসে ২৬.৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় তেইশ শতাংশ বেশি। আগস্ট বিপ্লবের পর থেকে প্রতি মাসে দেশে গড়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যায়। ২০২৫ সালে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে তা আগের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

২০২৫ সালের জানুয়ারি, ফ্রেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসে রেমিট্যান্স দেশে প্রবেশ করে যথাক্রমে ২.১৮ বিলিয়ন, ২.৫৮ বিলিয়ন, ২.৬৩ বিলিয়ন ও ২.৭৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল যথাক্রমে ৩.২৯ বিলিয়ন, ২.৫২ বিলিয়ন, ২.১৮ বিলিয়ন এবং ২.০৪ বিলিয়ন ডলার। এবারের ঈদের আগের মাস তথা মে মাসে রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ আরো অনেক বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বিশাল অঙ্কের রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির চাকাকে যেমন সচল করেছে, পতিত সরকারের তলানিতে যাওয়া রিজার্ভকেও শক্তিশালী করছে। তবে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ অনেক বেড়ে যায়। এবারের কুরবানির ঈদের আগের মাস মে-তে রেমিট্যন্স আরো বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পরিশেষে : ঈদুল আযহা আমাদের জাতীয় জীবনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির সমৃদ্ধি ও অগ্রগতিতে বিশাল অবদান রেখে চলেছে। ঈদের অর্থনীতি সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। তবে আশা করা যায়, মুক্ত পরিবেশে এবারের ঈদ অর্থনৈতিক উন্নতিতে আরো বেশি অবদান রাখবে।

Check Also

ছোট গাছে সাত ছড়া সৌদি খেজুর, লাভের আশা সাতক্ষীরার চাষির

সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের কালীগঞ্জ উপজেলার মৌতলা ইউনিয়নে যখন পৌঁছালাম, সূর্য তখন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।