আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ প্রতিশ্রুতি, নির্দেশনা আর সরকারী পদক্ষেপে ফাইলবন্ধি সাতক্ষীরা বাসির স্বপ্নের রেল পথ। বাজেট আসে আর যাই কিন্তু রেল আসেনা। ১১১ বছর পূর্ব থেকে সাতক্ষীরার মানুষ রেলের স্বপ্ন দেখছে। কৃষি উৎপাদন, মৎস্য চাষ, সুন্দরবন ও পর্যটন, ভারতের সাথে ব্যবসা—বানিজ্যের ক্ষেত্রে সাতক্ষীরার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এখানকার মোট কৃষি জমির এক—তৃতীয়াংশের বেশি জমিতে বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ করা হয়। জেলায় মাছের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত প্রায় ৯০ হাজার মেট্রিক টন মাছের এর একাংশ বিদেশে রপ্তানি এবং অবশিষ্ট মাছ দেশের অন্যান্য এলাকায় সরবরাহ করা হয়। আম, কুল, ধানসহ শাক সবজির ক্ষেত্রেও সাতক্ষীরা জেলা উদ্বৃত্ত খাদ্য শস্য উৎপাদন করে। এই উদ্বৃত্ত খাদ্য শস্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন করা হয়। যার একটা বড় অংশ দেশের বিভিন্নস্থান ছাড়াও দেশের বাইরে রপ্তানী হয়। সড়ক পথে সুন্দরবন ভ্রমনের একমাত্র সুযোগ রয়েছে সাতক্ষীরা জেলায়। ঢাকা বা দেশের অন্যান্য স্থান থেকে যে কোন যানবাহনে সাতক্ষীরা শহরের উপর দিয়ে শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ পৌছালেই চুনকড়ি নদীর ওপারে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। পর্যটনে কক্সবাজারের পরেই সুন্দরবন হতে পারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্পট। বাংলাদেশ—ভারতের মধ্যকার ২৭২কি.মি. সীমান্ত রয়েছে সাতক্ষীরা জেলায়। এখানকার ভোমরা স্থল বন্দর থেকে মাত্র ৮০কি.মি. দূরত্বে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা শহর অবস্থিত। কোলকাতা সমুদ্র বন্দরের সবচেয়ে নিকটে রয়েছে অধুনালুপ্ত সাতক্ষীরার বসন্তপুর নৌবন্দর। এটিই বাংলাদেশÑভারতের মধ্যকার ব্যবসা—বানিজ্যের সেতুবন্ধনকারী একমাত্র নৌবন্দর। এবছর সাতক্ষীরায় উৎপাদিত আম কুরিয়ারে ঢাকায় পাঠাতে কেজি প্রতি খরচ হয়েছে ১২ থেকে ১৫ টাকা। প্যাকিংসহ অন্যান্য খরচ যোগ করলে প্রতি কেজির খরচ ২০ টাকার কম নয়। একই আম চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে রেলওয়ের মাধ্যমে ঢাকায় পাঠাতে প্রতি কেজির খরচ হয়েছে ১টাকা ৩১ পয়সা। রেলে ঝুক্কি—ঝাকি কম হওয়ায় প্যাকিংসহ অন্যান্য খরচ কম। ফলে রেলে আম পরিবহনে প্যাকিংসহ খরচ গড়ে ৫টাকার বেশি নয়। সাতক্ষীরা এবং চাপাইনবাবগঞ্জের এই আম পরিবহনের খরচের পার্থক্য গড়ে প্রায় ১৫ টাকা। সেক্ষেত্রে সাতক্ষীরার আম তুলনামূলক সুস্বাদু হওয়া সত্বেও পরিবহন ব্যয়ের এই পার্থক্যের কারনে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পিছিয়ে পড়ছে।
অনুমোদন পাওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়ন না হওয়া নাভারণ থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথের দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন করেছে সাতক্ষীরার সর্বস্তরের জনসাধারণ। মঙ্গলবার (৩ জুন) বেলা ১১টায় সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এ কর্মসূচির আয়োজন করে সাতক্ষীরা জেলার সর্বস্তরের জনগণ। পরে একই দাবিতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সাতক্ষীরার যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে পন্য পরিবহনের সিংহভাগ ছিল নদী কেন্দ্রীক। তখন সড়ক পথে খুলনায় যেতে হতো যশোর হয়ে এবং সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় যেতে সময় লাগতো ১৫/২০ ঘন্টা। নৌপথ বন্ধ হওয়ার পর সারাদেশের সাথে সাতক্ষীরার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এখন সড়ক পথ। সারাদেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগন্তরকারী উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে সাতক্ষীরায় সড়ক উন্নয়ন হয়েছে কম। এর অন্যতম প্রধান কারন মনে করা হয় সাতক্ষীরা বাংলাদেশের দক্ষিণ—পশ্চিমাঞ্চলের সর্বশেষ জেলা। বাংলাদেশে প্রথম রেলওয়ের সূচনা হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর দর্শনা—জগতি রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে। ১৮৮২—৮৪ সালের মধ্যে সেন্ট্রাল রেলওয়ে নামে পরিচিত বনগাঁ—যশোর—খুলনা ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হয়। এসময় নাভারনে রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়। ১৯১৪ সালে ভাইসরয় অব বৃটিশ ইন্ডিয়া কলকাতা থেকে নাভারণ হয়ে সাতক্ষীরার মধ্য দিয়ে সুন্দরবন পর্যন্ত রেল লিংক স্থাপনের নির্দেশ দেন এবং সেটি অনুমোদনও করেন। ১৯৫৮ সালে সাতক্ষীরা ভেটখালী সড়ক নির্মাণের সময়েও রেলের জায়গা রেখে জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা নেওয়ার কথা শোনা যায়। কালেক্রমে দেশে ২ হাজার ৮৭৭ কিঃমিঃ রেল লাইন নির্মাণ করা হয়। রেল নেটওয়ার্কে দেশের ৪৪টি জেলা সংযুক্ত হয়। অগ্রগতি যেটুকু হয়েছে সেটি গত ১০ বছরে সম্ভাব্যতা যাচাই, নাভারন থেকে সাতক্ষীরা এবং সাতক্ষীরা থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত দুটি পৃথক প্রকল্প তৈরী, পিডিপিপি প্রণয়ন এবং অর্থের জন্য দাতা অনুসন্ধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সবকিছুই এখন দাতা খোঁজার প্রক্রিয়ার মধ্যেই ফাইল বন্দি।
প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানারেইল কোম্পানি লিমিটেড সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কার্যক্রম সম্পন্ন করে এবং এ সম্পর্কিত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেয়। নাভারণ—সাতক্ষীরা—মুন্সিগঞ্জ রেললাইনের সম্ভাব্যতা ম্যাপে নাভারণ থেকে সাতক্ষীরা হয়ে শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ গ্যারেজ পর্যন্ত ৯৮ দশমিক ৪২ কিলোমিটার এলাকায় মোট আটটি স্টেশনের কথা বলা হয়। স্টেশনগুলোর সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করা হয় নাভারণ, বাগআচড়া, কলারোয়া, সাতক্ষীরা, পারুলিয়া, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর ও মুন্সীগঞ্জে। এছাড়া ম্যাপে বাঁকাল, লাবণ্যবতী, সাপমারা খাল ও কাকশিয়ালী নদীর ওপর রেল সেতু নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করা হয়। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, নাভারন থেকে বাগআচড়া স্টেশনের দূরত্ব ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার, বাগআচড়া থেকে কলারোয়া ১২ দশমিক ৬৮, কলারোয়া থেকে সাতক্ষীরা ১৪ দশমিক ২৩, সাতক্ষীরা থেকে পারুলিয়া ১৫ দশমিক ১১, পারুলিয়া থেকে কালিগঞ্জ ১৮ দশমিক ৩৭, কালিগঞ্জ থেকে শ্যামনগর ১৩ দশমিক ৮২ ও শ্যামনগর থেকে মুন্সীগঞ্জ স্টেশনের দূরত্ব হবে ১১ দশমিক ৮১ কিলোমিটার। প্রকল্পটি মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের পরিবর্তে আরও ১০ কি.মি. বাদ দিয়ে শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ গ্যারেজ বাজার পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয় এবং সেটিরই পিডিপিপি প্রণয়ন করা হয়।
এর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ‘কন্সট্রাকশন অব নিউ বিজি ট্র্যাক ফর্ম নাভারন টু সাতক্ষীরা’ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৩২৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা চীনের কাছে থেকে ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়। প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৬৬২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৩৩২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। পাকিস্তান শাসন আমলে ১৯৫৮ সালে সাতক্ষীরা—ভেটখালী সড়ক নির্মাণের সময়ও রেললাইনের জায়গা ধরে জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা করা হয়। তখনও রেলের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। কিন্তু সে প্রক্রিয়া বেশিদুর যায়নি।
এই পরিস্থিতির অবসানে জরুরিভাবে নাভারন—সাতক্ষীরা—মুন্সিগঞ্জ রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সরকারের আশু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আর সেজন্য প্রয়োজন সাতক্ষীরার রাজনীতিবীদ, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ।
এবিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহম্মেদ জানান, সাতক্ষীরা বাসির স্বপ্নের রেল পথ বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু হবে।
আবু সাইদ বিশ^াস
সাতক্ষীরা
১১/৬/২৫