মাদার তেরেসা পুরস্কারে ভূষিত ফারাজ হোসেন নায়ককে অভিবাদন

ক্রাইমবার্তা বিনোদন ডেস্ক:ছবিটা এ রকম। গতকাল রোববার ভারতীয় সময় রাত নয়টা। এখনই শেষ হলো পয়লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর অন্যতম শহীদ ২০ বছরের ফারাজ আইয়াজ হোসেনের ওপর তোলা একটা অডিও ভিজ্যুয়াল। শেষ শটটায় ফ্রেমের আধখানাজুড়ে thamস্মিতহাস্য ফারাজের মুখ, বাকি আধখানাজুড়ে বড় বড় করে লেখা, ‘হি চোজ ফ্রেন্ডস ওভার লাইফ’।ভারতের মুম্বাইয়ে গতকাল ‘মাদার তেরেসা পুরস্কার’ প্রদান অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ, পুরস্কারপ্রাপ্ত ফারাজ হোসেনের মা সিমিন হোসেন, ভারতের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা মহেশ ভাট ও ফারাজের ভাই যারেফ হোসেন l ছবি: এএফপিমুম্বাইয়ের বিমানবন্দরের কাছে পাঁচতারা জে ডব্লিউ ম্যারিয়ট হোটেলের প্রধান হলের

নিভে যাওয়া সব আলো জ্বলে উঠল। ঘোষিকা মঞ্চে আসতে অনুরোধ করলেন ফারাজের মা সিমিন হোসেন ও বড় ভাই যারেফকে। মঞ্চে ততক্ষণে উঠে এসেছেন আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও মাদার তেরেসার অনুগামী সিস্টার প্র্যাকসি। তাঁদের পুরস্কার নেওয়ার পর বক্তব্য দিচ্ছেন পুরস্কারপ্রাপ্ত ফারাজ হোসেনের মা সিমিন হোসেন ছবি: এএফপিমাঝখান দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন পুত্রসহ সিমিন। হলের সবাই উঠে দাঁড়িয়েছেন অবিরাম করতালির মধ্যে।ফারাজ হোসেন
হারমনি ফাউন্ডেশনের মাদার তেরেসা স্মৃতি পুরস্কারের শেষটা এভাবেই হলো ফারাজকে সম্মান জানানোর মধ্য দিয়ে। মায়ের হাতে ছেলের সম্মাননা তুলে দিলেন হামিদ কারজাই ও সিস্টার প্র্যাকসি। এই প্রথম বিদেশি কোনো ‘নায়ক’কে মরণোত্তর সম্মান জানাল হারমনি ফাউন্ডেশন। সৃষ্টি হলো সংগঠনের এক নতুন অধ্যায়ের।

সিমিন হোসেন প্রথমেই বললেন, ‘ছেলেকে আমি মানুষের মতো একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছি। ফারাজ যাদের ভালোবাসে, যারা তার বন্ধু, তাদের ছেড়ে সে কাপুরুষের মতো আচরণ করেনি। ফারাজ, তোমার জন্য আজ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে গর্বিত মা।’ পুরো হল ফের ফেটে পড়ল করতালিতে।পুরস্কার গ্রহণের পর অনুষ্ঠানে আসা এক অতিথির সঙ্গে কথা বলছেন পুরস্কারপ্রাপ্ত ফারাজ হোসেনের মা সিমিন হোসেন, পাশে ফারাজ হোসেনের ভাই যারেফ হোসেন। ছবি: এএফপি

জে ডব্লিউ ম্যারিয়ট হোটেলের প্রধান হলের ঠিক বাইরে মালালা ইউসুফজাইয়ের একটা ছবি। ২০১২ সালে এই মাদার তেরেসা পুরস্কার পাওয়ার পর যে কথা তিনি বলেছিলেন, স্মিতহাস্য ছবির নিচে তা লেখা। মালালার কথাটি এ রকম, ‘আমার স্থির বিশ্বাস, মনকে প্রকৃত শিক্ষিত করার মধ্য দিয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তবে শুধু মনের দীক্ষাই নয়, প্রয়োজন হৃদয় ও অন্তরাত্মাকে শিক্ষিত করা।’মাদার তেরেসার প্রতিষ্ঠিত দাতব্য সংস্থার মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টার প্রিসিলার কাছ থেকে সম্মাননা সনদ গ্রহণ করছেন ফারাজ হোসেনে মা সিমিন হোসেন। ছবি: এএফপি
কী আশ্চর্য, ফারাজের ওপর তৈরি ছোট্ট অডিও ভিজ্যুয়াল শেষ হওয়ামাত্র যখন ঘোষিত হলো অকালে পুত্রহারা সিমিন হোসেন ও ভ্রাতৃহারা যােরফের নাম, সংক্রামক ব্যাধির আগ্রাসনের মতো সবার চোখ যখন চিকচিক করছে, মালালার কথাটি তখনই বাঙ্‌ময় হয়ে উঠল। শুধু শিক্ষা নয়, প্রয়োজন হৃদয় ও অন্তরাত্মার প্রকৃত শুদ্ধি। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসা ১৯ বছরের মালালা যে কথাটি পুনর্জন্ম পেয়ে বলতে পেরেছিলেন, জীবন দিয়ে সেই কথাটাই তো বলে গেলেন ২০ বছরের ফারাজ! একই উপমহাদেশের একই জলবায়ুতে বড় হওয়া একই বয়সী দুই কিশোর-কিশোরীর উপলব্ধি উপস্থিত সবার হৃদয় থেকে হৃদয়ে অনুরণিত হতে থাকল!পুরস্কার নেওয়ার পর বক্তব্য দিচ্ছেন ফারাজ হোসেনের মা সিমিন হোসেন (পেছনের পর্দায়)। মঞ্চে (বাঁ থেকে) আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, মাদার তেরেসার প্রতিষ্ঠিত দাতব্য সংস্থার মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টার প্রিসিলা, ফারাজের ভাই যারেফ হোসেন। ছবি: এএফপি
মঞ্চে উঠে গেলেন জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ ও চিত্রপরিচালক মহেশ ভাট। সিমিনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ফারুকের কণ্ঠ রুদ্ধ হলো। কোনোরকমে কান্না চেপে সিমিনের হাত ধরে তিনি বললেন, ‘আপনি প্রকৃতই শিক্ষিত করেছেন ফারাজকে। ফারাজ শুধু আপনার ছেলে নয়। ফারাজ সারা পৃথিবীর নায়ক।’ তারপর উপস্থিত সবার উদ্দেশে বললেন, ‘আসুন, আজ এই সন্ধিক্ষণে আমরা সবাই হাতে হাত ধরে মানববন্ধন করে শপথ নিই, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমরা জয়ী হবই। সন্ত্রাসের জবাবে সন্ত্রাস নয়, আমরা হৃদয়ের বদল ঘটাব। এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।’

অতঃপর মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবাই মানবিক হয়ে সন্ত্রাস দমনে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন। আঙুলে আঙুলে সবার শিকলি কাটা। হাত তোলা মাথার ওপর। চিবুক দৃঢ়।

মাদার তেরেসার প্রতিষ্ঠিত দাতব্য সংস্থা মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টার প্র্যাকসির‍ কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন ফারাজ হোসেনের মা সিমিন হোসেন l ছবি: এএফপিসদ্য যৌবনে পা দেওয়া এক কিশোরের পক্ষে কী করে সম্ভব এই সাহস অর্জন করা? জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গ না ছাড়ার এই সংকল্প ২০ বছরের এক যুবক কী করে আয়ত্ত করতে পারেন? হলের থিকথিকে ভিড়ে বিস্ময় হয়ে জেগে রইল সেটাই। অনুষ্ঠান শেষে ফারুক আবদুল্লাহ ও হামিদ কারজাই প্রথম আলোকে তার যে ব্যাখ্যা দিলেন, অতি সংক্ষেপে তা পরিবারের শিক্ষা ও মূল্যবোধ।

মালালা যে শিক্ষার কথা বোঝাতে চেয়েছেন, সেটারই অপর নাম এই পারিবারিক শিক্ষা বা ‘আপব্রিঙ্গিং’। আর মূল্যবোধ? দেশ, জাত, ধর্ম, বর্ণকে ছাপিয়ে পয়লা জুলাইয়ের হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসীদের কুনাট্যের পাশাপাশি পরম মানবিকতার যে চিত্রনাট্য লেখা হয়েছিল, সেটাই আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বজোড়া বন্ধুতার নতুন সংজ্ঞা। হিতোপদেশের সেই ভালুকের গল্প আজ নতুন আকারে নতুন উদাহরণ হয়ে উপস্থিত। প্রকৃত বন্ধু সে-ই, বিপদে বন্ধুকে ছেড়ে যে প্রাণ বাঁচাতে পালায় না। ফারাজকে সম্মানিত করে হারমনি ফাউন্ডেশন সেই সংজ্ঞাকে স্বীকৃতি দিয়ে নিজেদেরই সম্মানিত করল। ফাউন্ডেশনের সভাপতি অ্যাব্রাহাম মাথাই প্রথম আলোকে সেটাই কবুল করে বললেন, প্রকৃত নায়ক তো তাঁরাই।

গতকাল ফারাজ হোসেনের পাশাপাশি আরও যাঁদের সম্মাননা দেওয়া হয়, সিরিয়ার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সিরিয়া সিভিল ডিফেন্স (দ্য হোয়াইট হ্যামলেটস), আফগান কন্যা সেলেনা বিফি, প্যান অ্যাম বিমানের কর্মী নীরজা ভানোত, মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলের মহাব্যবস্থাপক করমবীর সিং কং, শান্তিকামী সংস্থা উইজডম ফাউন্ডেশনের ডা. জীনাত শওকত আলী, ঘানার সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা নানা আকুফো আডো, জম্মু ও কাশ্মীরের রুখসানা কাউসার। ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাইয়ের জঙ্গি হামলায় নিরাপত্তাবাহিনীর নিহত সদস্যদের মাদার তেরেসা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছে।‘মাদার তেরেসা পুরস্কার’ প্রদান অনুষ্ঠানে ফারাজ হোসেনের মা সিমিন হোসেন (ডান থেকে পঞ্চম), ফারাজের ভাই যারেফ হোসেন (ডান থেকে তৃতীয়), আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই (বাঁ থেকে চতুর্থ), ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ (বাঁ থেকে পঞ্চম), ভারতের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা মহেশ ভাটসহ অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। ছবি: এএফপি

মুম্বাইয়ের এই অনুষ্ঠানে হামিদ কারজাই ও ফারুক আবদুল্লাহর পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন ঘানার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নানা আকুফো আডো, শ্রীলঙ্কার মন্ত্রী এরান বিক্রমরত্নে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল রহমানবিন মোহামেদ আল ওয়াসি, বলিউডের অভিনেত্রী সোনম কাপুর প্রমুখ।আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের হাত থেকে ‘মাদার তেরেসা পুরস্কার’ গ্রহণ করছেন পুরস্কারপ্রাপ্ত ফারাজ হোসেনের মা সিমিন হোসেন। ছবি: এএফপি

সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য ২০০৫ সাল থেকে প্রতিবছর মাদার তেরেসা স্মৃতি আন্তর্জাতিক পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এটাই মাদার তেরেসার নামে দেওয়া একমাত্র পুরস্কার, যেটি তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টার প্রেমার দ্বারা অনুমোদিত। এর আগে এ পুরস্কার যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই, আফগানিস্তানের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ড. সিমা সমর, ব্রিটিশ হাউস অব লর্ডসের সাবেক ডেপুটি স্পিকার ব্যারোনেস ক্যারোলিন কক্স প্রমুখ।‘মাদার তেরেসা পুরস্কার’ গ্রহণের পর ক্যামেরাবন্দী পুরস্কারপ্রাপ্ত ফারাজ হোসেনের মা সিমিন হোসেন ও ফারাজের ভাই যারেফ হোসেন ছবি।: এএফপি

মুম্বাইভিত্তিক হারমনি ফাউন্ডেশন এ পুরস্কারটি দেয়। ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে এ ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন ড. আব্রাহাম মাথাই। যেকোনো ধরনের বৈষম্য দূর করে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠাই এ ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যকে সফল করতে মহেশ ভাট, অ্যাডমিরাল বিষ্ণু ভগত, তুষার গান্ধীর মতো বিশিষ্টজনদের সহযোগিতায় হারমনি ফাউন্ডেশন সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক মাদার তেরেসা স্মৃতি আন্তর্জাতিক পুরস্কারের প্রচলন করে।

Check Also

সুশাসন নিশ্চিতে রাষ্ট্রকাঠামো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ চায় টিআইবি

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উত্তাল পুরো দেশ। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও গুলিতে দুই …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।