ঢাকা, ২৫ মে : আজ বুধবার ১১ জ্যৈষ্ঠ, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৭ তম জন্মবার্ষিকী। তিনি চির প্রেমের কবি। তিনি যৌবনের দূত। তিনি প্রেম নিয়েছিলেন, প্রেম চেয়েছিলেন। মুলত তিনি বিদ্রোহী কিন্তু তার প্রেমিক রুপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই বলতে পারেন ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আয়নায়।’ পৃথিবীতে এমন কয়জন আছেন যিনি প্রেমের টানে রক্তের সর্ম্পকে অস্বীকার করে পথে বেরিয়ে পড়তে পারেন? তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ তার ১১৭ তম জন্মবার্ষিকী। বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। তাঁর ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন।
জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে পৃথক বাণী দিয়েছেন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হবে কবিকে নিয়ে নিবন্ধ। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন সহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠান মালা। দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও শোষিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে আসা কবির জন্মবার্ষিকীর দিনটি জাতি গভীর শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালবাসায় উদযাপন করবে। এ বছর জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে চট্রগ্রামে। এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন নজরুল ইন্সটিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি প্রফেসর ইমেরিটাস রফিকুল ইসলাম ও জাতীয় কবির পৌত্রী খিলখিল কাজী। স্বাগত বক্তব্য দেবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আক্তারী মমতাজ এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন। এছাড়াও ঢাকাসহ জাতীয় কবির স্মৃতি বিজড়িত ময়মনসিংহের ত্রিশালে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর ১১৭তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হবে।
ঐদিন সকালে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ কবির সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হবে। কবির জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে নজরুল ইন্সটিটিউট ও নজরুল একাডেমী বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহন করেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর ১১৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এ উপলক্ষ্যে সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং ছাত্রী-ছাত্রীরা কলা ভবন প্রাঙ্গণে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সমবেত হবেন এবং সেখান থেকে সকাল ৬ টা ৩০ মিনিটে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে শোভাযাত্রা সহকারে কবির মাজারে গমন করবেন।
উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কবির মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। পরে মাজার প্রাঙ্গণে উপাচার্যের সভাপতিত্বে এক স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘নজরুল গবেষণা কেন্দ্র’র আয়োজনে ১১৭তম ‘নজরুল জন্মবার্ষিকী’ উপলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে ‘নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা’ শিরোনামে বিকাল ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার আর্টস মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
বাংলা কবিতায় নজরুলের আর্বিভাব একেবারেই উল্কার মত। বাংলা সাহিত্যে আর্বিভ’ত হয়ে সমস্ত আকাশকে কিভাবে রাঙ্গিয়ে গেলেন অথবা উজ্জ্বল করে দিলেন তা নিয়ে এখনো গবেষনা হচ্ছে দেশ-বিদেশে। কোন সঞ্জীবনি মন্ত্রে তিনি উচ্চকন্ঠে বলতে পারেন ‘ বল বীর ,বল উন্নত মম শির’ অথবা মহাÑবিদ্রোহী রণÑক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দলÑরোল আকাশেÑবাতাসে ধ্বনিবে না,/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণÑভূমে রণিবে নাÑ’।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণÑভূমে রণা বন্ধ হয়নি কিংবা উৎপীড়িতের ক্রন্দলÑরোলও কখনো থামেনি । আর সেই কারনেও নজরুল আমাদের কাছে এখনো প্রাসঙ্গিক। আসলে বিদ্রোহী কবি যেমন ছিলেন নির্ভিক , তেমনি এই প্রেমিক কবি ছিলেন রোমান্টিক। রোমান্টিকতার আতিশয্য ও অভিমানে ভরা তার অনেক গান গত শতকের অনেকটা সময় ধরে বাঙ্গালীর হৃদয়রাজ্যে বিচরন শুরু হয়-যা আজও দিপ্যমান।
সংগীত বিশিষ্টজনদের মতে রবীন্দ্রনাথ -পরবর্তি নজরুলের গান অনেকটাই ভিন্ন ধরনের নির্মান। অধিকাংশ গান সুরপ্রধান। বৈচিত্রপূর্ণ সুরের লহরী কাব্যকথাকে তরঙ্গায়িত করে এগিয়ে নিয়ে যায় । সুরের বিন্যাসের উপরে কথা ঢলে পড়ে। তার গানে বহু গায়ক সুর-স্বাধীনতা ভোগ করেন। অনেক ক্ষেত্রে গায়ক সুরের ঢেউয়ে বেশী মেতে যান। তখন গান হয়ে যায় রাগপ্রধান।
নজরুল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, নজরুল ইতিহাস ও সময় সচেতন মানুষ ছিলেন যার প্রভাব তাঁর লেখায় স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।তিনি বলেন, তুরস্কে কামাল পাশার নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ¬¬ব আর ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের তরঙ্গকে নজরুল তাঁর সাহিত্যে বিপুলভাবে ধারণ করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসা¤প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনি জাতীয় জীবনে অসা¤প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে স্বপরিবারে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি দিয়েছিলেন।
এবিএন/বুধ-১ম/এক্সক্লুসিভ/সাহিত্য-সংস্কৃতি/ডেস্ক/কেসি/মুস্তাফিজ/এমআর