আচম্বিত ঘোষণায় বেসামাল আমজনতা
৮ নভেম্বর, মঙ্গলবার সন্ধেয় যখন সারা ভারত সবেমাত্র ঘরে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছে, তখনই এসেছিল প্রধানমন্ত্রীর সেই অতর্কিত ঘোষণা।
কাউকে আগে থেকে ঘুণাক্ষরেও কিছু আঁচ না-দিয়ে নরেন্দ্র মোদি জানিয়ে দিলেন, সেদিন মধ্যরাতের পর থেকেই দেশে ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল হয়ে যাচ্ছে, ব্যাঙ্কে জমা না-পড়লে সেগুলোর মূল্য বাজে কাগজের টুকরোর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
প্রধানমন্ত্রী জানালেন, দুর্নীতিগ্রস্ত কালো টাকার মজুতদারদের নিশানা করেই এই পদক্ষেপ।
কিন্তু পরদিন সকাল থেকে সারা দেশে যে নৈরাজ্য শুরু হয়ে গেল, তাতে সবচেয়ে বেশি নাকাল হতে লাগলেন সাধারণ মানুষ, বাজারের ছোট দোকানদার কিংবা দিন-এনে দিন-খাওয়া মেহনতি মানুষজন, যাদের রুটিরুজির অর্থনীতি এখনো পুরোপুরি ‘নগদ নির্ভর’।
আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেশের সব ব্যাংক আর এটিএম মেশিনের সামনে শুরু হয়ে গেল হুড়োহুড়ি আর লম্বা লাইন, যে অপেক্ষা আরো শেষ হয়নি।
মানুষ সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়েও নতুন নোট কিংবা পুরনো ১০০’র কিছুই পেলেন না, এমনও ঘটতে লাগল রোজ। স্পষ্ট হয়ে গেল, ভারতের ব্যাংকগুলোর এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো কোনো প্রস্তুতিই ছিল না।
কিন্তু মানুষের এমন চরম ভোগান্তি হবে জেনেও প্রধানমন্ত্রী মোদি কেন কোনো আগাম সতর্কতা ছাড়াই এত বড় একটা নাটকীয় সিদ্ধান্ত নিতে গেলেন? আর যদি বা নিলেন, তার ধাক্কা সামলানোর মতো প্রস্তুতি কেন নেয়া গেল না?
যদিও বলছেন কালো টাকার কারবারিদের কাবু করতেই এই পদক্ষেপ, প্রথম কয়েক দিনে কিন্তু ভারতের সাধারণ মানুষ, ছোট ব্যবসায়ী কিংবা শ্রমিক-কর্মচারীরাই এই সিদ্ধান্তের জেরে সবচেয়ে বেশি নাকাল হচ্ছেন।
প্রস্তুতি ছিল না ধাক্কা সামলানোর?
দিল্লির বরিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক জয়ন্ত ঘোষাল এ প্রশ্নের জবাবে বলছিলেন, “এই সিদ্ধান্তটা উনি কাউকে না-জানিয়ে নিয়েছেন কারণ সেটা না-করলে যারা এই আক্রমণের নিশানা, সেই কালো টাকার মজুতদাররা হয়তো সাবধান হওয়ার সুযোগ পেয়ে যেত … সেই টাকা পাচার করে দিত বা হাওয়ালা করে দিত।”
“প্রধানমন্ত্রী সেই গোপনীয়তা রক্ষা করেছেন ঠিকই, কিন্তু তা করতে গিয়ে দেশের অবকাঠামো এর জন্য প্রস্তুত কি না সেটা বুঝতে পারেননি। এর আগে যখন ১৯৭৮ সালে মোরারজি দেশাই অনুরূপ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন – সে আমলে এত এটিএম মেশিন বা প্লাস্টিক কার্ড ছিল না, কিন্তু তারপরও সরকার পরিস্থিতি সামলাতে বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল – এরকম নৈরাজ্য হয়নি।”
“এই ভুলগুলোর কথা এখন প্রধানমন্ত্রী নিজেও ঘনিষ্ঠ মহলে স্বীকার করছেন – এবং রাত জেগেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মানুষের হাতে টাকার জোগান বজায় রাখতে। তবে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে পারে, এই আশঙ্কা কিন্তু প্রশাসনেরও আছে।”
ছোট নোটের অমিলে অগত্যা হতাশা, বিভ্রান্তি ও মানুষের অসহায়তা এখনও অব্যাহত। বারো বছর ধরে বিজেপি-র এমপি ছিলেন চন্দন মিত্র, তারও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই পরিস্থিতিটা সরকারের আরও ভালভাবে সামলানো উচিত ছিল।
তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, “মোদিজির দৃঢ় বিশ্বাস এটা শর্ট টার্ম পেইন – কিন্তু লং টার্ম গেইন, অর্থাৎ সবুরে এর সুফল ঠিকই মিলবে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই এখন মানুষের খুবই কষ্ট হচ্ছে, দিনের পর দিন ব্যাঙ্কের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে তারাও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছেন। নিজের টাকা ব্যাঙ্ক থেকে বের করতে না-পেরে সঙ্গত কারণেই তারা ক্ষুব্ধ।”
“আর কতগুলো ব্যাপারে একটু আগে থেকে তৈরি হলে … যেমন ধরুন, সরাসরি দুহাজার টাকার নতুন নোট বাজারে চলে এলো। অথচ ব্যাঙ্কের কাছে বা মানুষের হাতে যথেষ্ট পরিমাণে একশো টাকার নোট নেই। আর ছোট অঙ্কের নোট না-থাকলে বাজারে দুহাজারের নোট দিয়ে আপনি কিছুই করতে পারবেন না – লোকে খুচরো দিতে চাইবে না। এর ফলে মানুষের অসুবিধা হচ্ছে, এগুলো নিয়ে আগে থেকে তৈরি হলে ভালো হতো। ”
ঘোষণার রাজনৈতিক অভিঘাত
নরেন্দ্র মোদির অতর্কিত হামলায় অধিকাংশ বিরোধী দল প্রথম বাহাত্তর ঘণ্টা এর প্রায় কোনো প্রতিক্রিয়াই জানাতে পারেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষের ভোগান্তিকে অস্ত্র করে প্রতিবাদ জানাতে লাগলেন তারা – আর তাতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় দেখা গেল তৃণমূল চেয়ারপার্সন ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে।
মমতা ব্যানার্জি অভিযোগ তুললেন, “কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই এসব করা হয়েছে। যদি ১% লোকের হাতে কালো টাকা থাকে, তার জন্য ৯৯% মানুষকে কষ্ট দিতে হবে? খুন করল কে আর সাজা পাচ্ছে কে? আসলে এই ব্ল্যাক ডিসিশনের ফায়দা লুটছে কিছু ব্ল্যাক মানি হোল্ডার আর মানি লন্ডারার। এটা ডেঞ্জারাস, ডিসঅ্যাস্টারাস ও ড্রাকোনিয়ান ডিসিশন।”
“আমি বলব সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন বর্তমান বিচারপতিকে দিয়ে তদন্ত করানো উচিত এই কদিনে দেশের কত লোকসান হল, কত আর্থিক বিপর্যয় হলো বা অর্থনীতিতে কত ধস নামল! এই টাকাগুলো কি কাউকে পাইয়ে দেয়ার জন্য করা হল?”
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে মমতা ব্যানার্জি শুধু তদন্ত দাবি করেই ক্ষান্ত হননি – অন্যান্য দলকে সঙ্গী করে পার্লামেন্ট থেকে মিছিল করে গিয়ে খোদ রাষ্ট্রপতির কাছে নালিশও জানিয়ে এসেছেন।
এমন কি এই লড়াইতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সিপিএমের হাত ধরতেও তিনি দ্বিধা করছেন না। বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও সিপিআইএমএল দলের নেতা দীপঙ্কর ভ্ট্টাচার্যও মনে করছেন এই সিদ্ধান্ত জনবিরোধী ও কালো টাকার মজুতদারদের তা কিছুই করতে পারবে না।
তার কথায়, “আমরা যেটা দেখছি সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা ব্যাংকগুলো নিয়ে নিয়েছে – আর মোদি মানুষের কাছে পঞ্চাশ দিন সময় চাইছেন। কিন্তু এই চরম ভোগান্তি তো আর পাঁচটা দিন সহ্য করাও তাদের জন্য অসম্ভব! ইতিমধ্যেই টাকার লাইনে দাঁড়িয়ে ২৬ জন মারা গেছেন। আমার মনে হয় সরকার যেন সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।”
“আর আমরা জানি কালো টাকা যাদের কাছে আছে তারা সেটা নগদে মজুত রাখেন না, অন্যভাবে রাখেন। কালো টাকার প্রবাহ চলছেই। মোদি এর আগে নিজেই বলেছিলেন ৯০ শতাংশ কালো টাকা বিদেশি ব্যাংকে লুকোনো আছে – আর এখন সেটাই ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট হয়ে দেশের ঘরে ঘরে কোন জাদুতে ঢুকে গেল তা তিনিই বলতে পারবেন। ফলে আজ যারা নোটের লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, তারা ঠিকই ভোটের লাইনে মোদিকে এর জবাব দেবেন।”
কী মূল্য দিতে হবে নরেন্দ্র মোদিকে?
দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে এই জল্পনাও ভাসছে – নরেন্দ্র মোদির আসল টার্গেট হলেন মুলায়ম সিং যাদব ও মায়াবতীর মতো নেতারা – উত্তরপ্রদেশে আসন্ন নির্বাচনের আগে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা জড়ো করেছিলেন বলে অভিযোগ।
এই জল্পনায় সত্যতা যতটাই থাক, নরেন্দ্র মোদি যে বিরাট একটা রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছেন তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই জয়ন্ত ঘোষালের।
তিনি বলছেন, “রাজীব গান্ধী যখন ভারতে টেলিকম বিপ্লব ঘটান, তখন কিন্তু ভোটের কথা ভেবে করেননি – স্যাম পিত্রোদাকে নিয়ে এসে ভারতে সমাজ সংস্কারের জন্যই সেটা করেছিলেন। মনমোহন সিং যখন আর্থিক সংস্কার শুরু করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমহা রাওয়ের নেতৃত্বে, তখনও কিন্তু অন্ধ্রের ভোটে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছিল।”
“এবারেও মনে করা হচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে দুটি আঞ্চলিক দলকে শায়েস্তা করার উদ্দেশে মানুষকে অসুবিধায় ফেলেও এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ – আর নরেন্দ্র মোদিকেও তার রাজনৈতিক দাম দিতে হতে পারে।”
“বিশেষ করে বিরোধী দলগুলো এটাকে একটা অনুঘটক বা ক্যাটালিস্টের মতো ব্যবহার করতে চাইছে – এবং এই সিদ্ধান্ত তাদের কনসলিডেট করতে সাহায্য করতে পারে। মমতা ব্যানার্জি আর রাহুল গান্ধীর মধ্যে বহুদিন বাদে কথা হল এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করেই – আর সেটাও তো বিরোধী ঐক্যের পথেই একটা অগ্রগতি!”
ফলে এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই ভারতের ছন্নছাড়া বিরোধী দলগুলো হয়তো আবার একজোট হওয়ার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। চন্দন মিত্র আবার মনে করেন, খুব শিগগিরি স্পষ্ট হয়ে যাবে এই সিদ্ধান্তের জন্য নরেন্দ্র মোদিকে কোনও রাজনৈতিক দাম দিতে হবে কি না।
ড: মিত্রর ধারণা, “রাজনৈতিক দাম চোকানোর বিষয়টা কিন্তু মানুষই শেষ পর্যন্ত ঠিক করে দেবে – তারাই চূড়ান্ত রায় দেবেন এই সিদ্ধান্ত তারা স্বীকার করছেন কি করছেন না। সামনেই উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, গোয়াতে নির্বাচন আসছে – আর তখনই আমরা এ প্রশ্নের জবাবও পেয়ে যাব।”
“কিন্তু পার্লামেন্টে বিজেপির যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা – তাতে বিরোধীরা সরকারকে তেমন কোনও বিপাকে ফেলতে পারবেন বলে মনে হয় না। নিশ্চয় সংসদে বাগবিতণ্ডা হবে, উত্তেজিত তর্কবিতর্ক হবে – কিন্তু তার বেশি কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না।”
কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই আর ঝুঁকির রাজনীতি
কিন্তু যে বামপন্থীরা চিরকাল এ দেশে কালো টাকার বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছেন, তারাও কেন এখন মোদির পাশে নেই?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য জবাবে বলছিলেন – কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়ার রাস্তা এটা নয়, আর দেশের আমজনতাই সেটা নরেন্দ্র মোদিকে বুঝিয়ে ছাড়বে।
“যদি মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য এত বড় মূল্য দিতে হয় – তাহলে যে শাসক মানুষের ওপর এত বড় দুর্দশা চাপিয়ে দিয়েছেন আমার মনে হয় মানুষ সেই সরকারকেও ঠিকই এর জবাব দেবেন।”
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য আরো বলছেন, “কথা ছিল বিদেশি ব্যাংকে যে ভারতীয়দের অ্যাকাউন্ট আছে তাদের তালিকা প্রকাশিত হবে, সে তালিকা আজও বেরোয়নি। ভারতের ব্যাঙ্কগুলো যে কর্পোরেটরা বিপুল টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি রয়ে গেছেন, সুপ্রিম কোর্ট তাদের নাম প্রকাশ করতে বলা সত্ত্বেও সরকার তা করেনি।”
“কর ফাঁকি দিচ্ছেন যারা কোনও ব্যবস্থা নেই তাদের বিরুদ্ধেও। ফলে এটা গিমিক ছাড়া কিছুই নয় – যে গিমিকে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া যাবে বলে সরকার ভেবেছিল। কিন্তু আমি নিশ্চিত মানুষ এই ধোঁকাবাজিটা ধরে ফেলেছে এবং সরকারকে এর দামও দিতে হবে। ”
ফলে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে দুঃসাহসী প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদি এখন এক জটিল রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে – দেশবাসী শেষ পর্যন্ত কতটা তার পাশে দাঁড়াবে তা আদৌ এখনও স্পষ্ট নয়।
জয়ন্ত ঘোষালের কথায়, “ভারতের দলিত সমাজ তাদের দলিত পরিচয় ভুলে এই সিদ্ধান্তের জন্য বিজেপিকে ভোট দেবে, কিংবা যাদব ভোট ব্যাংক তাদের যাদব পরিচয় ভুলে কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নরেন্দ্র মোদিকে মসিহা ভাবতে শুরু করবেন এটা মনে করাটাও আবার অতি-সরলীকরণ হয়ে যায়।”
“ফলে নরেন্দ্র মোদির জন্য ঝুঁকি আছে দুদিক থেকেই – আমাদের মতো দেশে নির্বাচনী সাফল্য এর জন্য ধরা দেবে কী দেবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই, আবার অন্যদিকে এর ফলে বিরোধী দলগুলোও হয়তো পার্লামেন্টে এককাট্টা হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল, সেই ঝুঁকিটাও থাকছে।”
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তুলতে প্রধানমন্ত্রী দেশের কাছে সময় চেয়েছেন পঞ্চাশটা দিন। তার আগেই ভোগান্তিতে নাকাল ভারতীয়দের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে, না কি সরকারের ঘোষিত যুদ্ধে তারাও সামিল হন – এখন রুদ্ধশ্বাসে দেখার অপেক্ষা সেটাই!
সূত্র : বিবিসি