অস্ত্রধারীদের খুঁজে পায় না পুলিশ!

 ক্রাইমবার্তা রিপোট:প্রকাশ্যে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। ছোট্ট ঘটনায়ও তারা গুলি ছোড়ে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেও ঘটে অস্ত্রবাজি। প্রতিরোধ কিংবা গ্রেফতার তো দূরের কথা, তারা এমন অবস্থান নেন, ‘যেন কিছুই দেখেননি’। ঘটনার পরই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় অস্ত্রধারীদের ছবি। চিহ্নিত হয় তাদের নাম-ঠিকানা-পরিচয়। কয়েকটি ঘটনায় অনন্যোপায় হয়ে মামলাও করে পুলিশ। ওই পর্যন্তই শেষ!

চিহ্নিত অস্ত্রধারীরা ঘুরে বেড়ালেও তারা গ্রেফতার হয় না। প্রায় প্রতিটি ঘটনায়ই পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলেই তারা প্রথাসিদ্ধ মন্তব্য করেন, ‘আমরা গ্রেফতারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ গত ২ নভেম্বর চট্টগ্রামে ও ২৭ অক্টোবর রাজধানীর গুলিস্তানে প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজিতে জড়িতদের ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একই কথা বলছেন।

অস্ত্রবাজদের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সারাদেশে আলোচনার ঝড় ওঠে। এর পরই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা ঘোষণা দেন- তারা যে দলেরই হোক না কেন, কোনো ছাড় নেই। সারাদেশে এমন ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়ে মিলেছে ভিন্ন চিত্র। পুলিশ তাদের ‘খুঁজে’ না পেলেও অস্ত্রধারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। এমনকি তারা বিভিন্ন কর্মসূচিতেও অংশ নেয়। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, এসব অস্ত্রবাজের দলীয় পরিচয় রয়েছে। তারা ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের বলয়ে থাকে। তাই অবস্থান জানলেও অনেক সময় তাদের আইনের আওতায় আনা যায় না।

গুলিস্তানের অস্ত্রবাজ সাবি্বর ও আশিক কোথায়?: ২৭ অক্টোবর রাজধানীর গুলিস্তানে হকার উচ্ছেদের সময় প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি হয়। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাবি্বর হোসেন ও ওয়ারী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছোড়ে। গণমাধ্যমে ওই ছবি প্রকাশের পরও তারা প্রকাশ্যে ছিল। পরে সংগঠন থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়। অস্ত্রবাজির স্পষ্ট ছবি থাকার পরও ঘটনার চার দিন পর তাদের ‘শনাক্ত’ করে হত্যাচেষ্টা মামলা করে পুলিশ। ততদিনে ওই দুই নেতা ‘লাপাত্তা’। ২৪ দিনেও তারা গ্রেফতার হয়নি। পুলিশ বলছে, সাবি্বর ও আশিক যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে সে জন্য ইমিগ্রেশনে জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের দাবি, ওই দুই নেতাকে গ্রেফতারে তাদের অভিযান অব্যাহত আছে। তবে কয়েকটি সূত্র জানায়, সাবি্বর অস্ত্রবাজির পরও কয়েকদিন ঢাকায় প্রকাশ্যে ছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনেও তাকে দেখা গেছে। তার মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, সে দেশেই আছে। আত্মগোপনে থেকে আশিক তার লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগও করছে। মামলা ধামাচাপা দিতে এ দুই নেতার ‘বড় ভাইরা’ তাদের হয়ে সরকারের বিভিন্ন মহলে তদবির করছেন বলেও জানা গেছে।

পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার সমকালকে বলেন, অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। এতে কারও প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেই। অস্ত্রধারীদের রাজনৈতিক পরিচয় কোনো বিষয় নয় বলে আগেই জানিয়েছিলেন ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন।

রাবির অস্ত্রবাজরা প্রকাশ্যেই: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাস এখন অনেকটাই ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। সংগঠনটির কয়েক নেতা আধিপত্য বিস্তার, দলীয় কোন্দল ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে অস্ত্রবাজি শুরু করে। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি করেও তারা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। উল্টো তাদের কয়েকজন সংগঠনে ভালো পদ পেয়ে ‘পুরস্কৃত’ও হয়েছে।

রাবি সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্ধিত ফি ও সান্ধ্য কোর্স বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চড়াও হয় ছাত্রলীগের পদধারী কয়েকজন নেতা। ওই সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে পুলিশের সামনেই গুলি করতে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুজ্জামান ইমন, আল-গালিব ও ফয়সাল আহম্মেদ রুনু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান পলাশ ও নাসিম আহম্মেদ সেতু, পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মুস্তাকিন বিল্লাহ এবং ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত সালামকে। ওই ঘটনার কিছুদিন পর শামসুজ্জামান ইমন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেও সে জামিনে বের হয়ে এখন একটি কলেজে শিক্ষকতা করছে। অন্য নেতাদের মধ্যে রুনু আর গালিব এখনও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়। মাহবুবুর রহমান পলাশ ও নাসিম আহমেদ সেতু অনেকটা নীরবে আছে। তবে গ্রেফতার এড়িয়ে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যেই মুস্তাকিন বিল্লাহ।

এর আগে ২০১২ সালে ছাত্রদলের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগের ওই সময়ের সহসভাপতি আখেরুজ্জামান তাকিম, সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদ আল তুহিনের হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গিয়েছিল। এর পর তুহিন সংগঠন থেকে বহিষ্কার হলেও পরে সাধারণ সম্পাদকের পদ পায়। তুহিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কার হলেও তাকে এখন রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা যায়। পুলিশের সামনে ঘুরলেও তাকে গ্রেফতার করা হয় না।

রাজশাহীর মতিহার থানার ওসি হুমায়ুন কবির বলেন, পুরনো ঘটনাগুলোয় মামলা হয়েছিল কি-না তা তার জানা নেই। তিনি আসার পর এ ধরনের প্রকাশ্য অস্ত্রবাজি আর হয়নি।

ইবিতেও একই অবস্থা: কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) অস্ত্রবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমন নজির নেই। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগের দু’পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। ওই সময় ইবি ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম পক্ষের শিশির ইসলাম বাবু অস্ত্র দিয়ে গুলি ছোড়ে। একই পক্ষের আসাদকেও পিস্তল দিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। ওই সংঘর্ষের সময় সহসভাপতি মিজানুর রহমান মিজুর পক্ষের শেখ নুরুজ্জামান জ্যোতি চাপাতি নিয়ে হামলা চালায়। এসব অস্ত্রবাজ এখনও ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইবি ক্যাম্পাসে অস্ত্র প্রশিক্ষণের দৃশ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। ওই ছবিতে দেখা গিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক সজীবুল ইসলাম সজীব দু’জনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সজীবের সহযোগী হিসেব ছবিতে ছাত্রলীগ কর্মী সালাহউদ্দিন আহমদকেও দেখা গিয়েছিল। এ ঘটনায় তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাসপেন্ড করার পর তা প্রত্যাহার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। সেই দুই প্রশিক্ষক এখনও ক্যাম্পাসে নিয়মিত।

ইবি থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, গত জুনে তিনি যোগ দিয়েছেন। এর আগে কারা অস্ত্রবাজি করেছে বা এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে কি-না তা তার জানা নেই।

চট্টগ্রামের দাঁতলা সুমন গ্রেফতার হয়নি: ১ নভেম্বর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে দিনভর চলে অস্ত্রের মহড়া। ওই সময় সুমন ওরফে দাঁতলা সুমন ও ফয়সল আহমদ রাজ নামে দু’জনের অস্ত্র হাতে ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও সুমনকে গ্রেফতার করা যায়নি। চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার ওসি মহিউদ্দিন বলেন, ওই ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলায় ১৭ জন গ্রেফতার হয়েছে। দাঁতলা সুমনকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

Check Also

পুলিশ ভেরিফিকেশনে থাকছে না রাজনৈতিক পরিচয়

পুলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় তুলে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পুলিশ সংস্কার কমিশন এ সুপারিশ করেছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।