দিনের বেলা হেলিকপ্টার ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী ‘রাখাইন রাজ্যে নরকের মতো পরিস্থিতি’

ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রিপোট: মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের বর্তমান অবস্থাকে নরকের সঙ্গে তুলনা করেছেন আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম। তিনি জানান, সেখানে গত প্রায় দেড় মাস ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে কমপক্ষে ৩৫০ জন নিহত হয়েছেন। জীবন বাঁচাতে পলায়নপর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশের প্রতিও তিনি আহ্বান জানান। বিবিসি বাংলা।

লন্ডন থেকে নূরুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, সেখানে এমন অত্যাচার চলছে যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। অক্টোবরের ৯ তারিখ থেকে তাদের হিসেবে কমপক্ষে ৩৫০ জন নিহত হয়েছেন।

নূরুল ইসলামের ভাষায়, ‘বহু নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। সাড়ে তিন হাজার বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরবাড়ি হারিয়েছেন ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ।’ তবে মিয়ানমার সরকার কোনও সাংবাদিককেই রাখাইন রাজ্যে যেতে দিচ্ছে না। ফলে নিরপেক্ষ কোনও সূত্র থেকে এসব দাবির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বলছে, তাদের অভিযানে ৬৯ জন নিহত হয়েছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নূরুল ইসলাম সেনাবাহিনীকে মিথ্যাবাদী উল্লেখ করে বলেন, এটা কোনওভাবেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। কারণ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক কিংবা সাংবাদিকদের সেখানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।

তিনি জানান, রাখাইন রাজ্যের স্থানীয় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। সেখানকার লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তার ভিত্তিতে তারা যেসব খবর পাচ্ছেন সেই চিত্রটা আরও অনেক বেশি ভয়াবহ। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উত্তর আরাকান এবং মংডু টাউনশীপে।

নূরুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তারা তল্লাশি চালাচ্ছে। লোকজনকে গুলী করে মেরে ফেলছে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে লোকজন যখন বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে; তখন হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে গুলীবর্ষণ করে তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যেখানে গিয়ে লুকাচ্ছে সেখানে, রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পথেঘাটে, খালে নদীতে তাদেরকে মেশিনগান দিয়ে গুলী করে মেরে ফেলা হচ্ছে।’

আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম বলেন, লোকজন নৌকায় করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চাইলে তাদের নৌকার ওপর গুলী করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করায় তারা উদ্বিগ্ন।

তিনি বলেন, যাদের নিরাপত্তা নেই তাদেরকে বাংলাদেশের আশ্রয় দেওয়া উচিত। তার ভাষায়, ‘আমাদের ওপর যে নির্যাতন চলছে তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। বাংলাদেশের উচিত তাদের জন্যে সীমান্ত খুলে দেওয়া। না হলে এই লোকগুলো যাবে কোথায়?’

নূরুল ইসলাম বলেন, ‘মনে করুন, আপনার ঘরে যদি আগুন জ্বলে তখন প্রতিবেশীর বাড়িতে আপনার আশ্রয় নিতে হবে। এজন্যে আপনাকে তো কোন অনুমতি নিতে হবে না।’

মিয়ানমার সরকারের কাছে তিনি আবেদন জানান, বেসামরিক লোকজনের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর এই অভিযান এখনই বন্ধ করতে, সাংবাদিকদের আক্রান্ত এলাকায় যাওয়ার অনুমতি দিতে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব ঘটনা বন্ধ করতে।

বাংলাদেশে অনেকের আশঙ্কা, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গ্রুপের সৃষ্টি হতে পারে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এ রকম কোনও ভয়ের কারণ নেই।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের এই লোকগুলোকে আশ্রয় দেওয়া উচিত শুধুমাত্র মানবিক কারণেই।’

রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী বলে মিয়ানমার সরকার অপ্রচার চালাচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব নিয়েই এখন টানাটানির সৃষ্টি হয়েছে।

হেলিকপ্টার আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী

মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অভিযানের ভয়ে পালিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা। টেকনাফের স্থানীয়রা বলছেন সীমান্ত রক্ষীদের কড়া প্রহরা সত্ত্বেও গোপনে তাদের প্রবেশ চেষ্টা অব্যাহত আছে। টেকনাফে মিয়ানমার সীমান্তে নাফ নদী। তার পাড়েই উলুবনিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও মৎস্য ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ শিকদার। মি.শিকদারের বাড়ি থেকে সীমান্তের ওপারে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত দেখা যায়। বাংলাদেশের সীমান্তে থেকে তারা দেখতে পাচ্ছেন দিনের বেলা ধোঁয়া উঠছে, তাদের ধারণা সেখানে বাড়ি ঘরে আগুন দেয়া হচ্ছে। মাঝে মাঝে হেলিকপ্টার দেখা যাচ্ছে।

তবে সীমান্তে তাদের ‘পুশব্যাক’ও অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ শুক্রবার ১২৫ জনকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

শিকদার বলছিলেন ‘কিছু লোক বিজিবিকে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। বিজিবি রয়েছে কঠোর প্রহরায়। তারপরেও রাতের অন্ধকারে ফাঁক ফোকর দিয়ে কিছু লোক কিন্তু ঢুকে যাচ্ছে।

ব্যবসায়ের কারণে যারা বাংলাদেশে আসছেন তাদের কাছে থেকে জানতে পারছেন কিছু বাড়ি ঘর জ¦ালিয়ে দেয়া হয়েছে মিয়ানমারে, কিছু লোককে টার্গেট করে গুলী করে মারা হয়েছে। মেয়েদের ধর্ষণের খবর তারা পেয়েছেন।

বাংলাদেশের সীমান্ত খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।

এদিকে আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের অবস্থাকে নরকের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন, সেখানে গত প্রায় দেড় মাস ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে কমপক্ষে সাড়ে তিনশো জন নিহত হয়েছে।

মিয়ানমারকে কেন চাপ দেয়া হচ্ছে না?

মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অভিযানের ভয়ে পালিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা। টেকনাফের স্থানীয়রা বলছেন সীমান্ত রক্ষীদের কড়া প্রহরা সত্তে¦ও গোপনে তাদের প্রবেশ চেষ্টা অব্যাহত আছে।

বাংলাদেশের সীমান্ত খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। কিন্তু মিয়ানমারকে কেন চাপ দেয়া হচ্ছে না?

শরণার্থী বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার বলছিলেন মিয়ানমারকে যতটা চাপ দেয়া প্রয়োজন ততটা দেয়া হচ্ছে না। শুধুমাত্র সে কারণেই এই সমস্যা জিইয়ে ছিল এবং অবস্থা এখন আরো খারাপ হচ্ছে। অতীতে চীনের কিছুটা চাপ ছিল এখন সেটাও নেই বলছিলেন সি আর আবরার । জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের কমিশন রোহিঙ্গা ইস্যুতে খুব একটা কাজ করতে পারবে বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকেরা।

সি আর আবরার বলেন আন্তর্জাতিক কমিউনিটি সময় নেয়ার জন্য এমন কমিশন গঠন করা হচ্ছে। তবে মূল উৎস রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের প্রধান দায়িত্ব বলে তিনি মন্তব্য করেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। সে হিসেবে মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার বিষয় রয়েছে বাংলাদেশের। সি আর আবরার বললেন লোকগুলো যখন জীবনের ভয়ে ভীত হয়ে আরেক দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করছে, তখন শুধু বাংলাদেশ না সব দেশের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন করার বিষয় রয়েছে। এটা একটা মানবিক সমস্যা।

ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে মিযানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। মিয়ানমারের সরকারকে সেখান মানুষদের নিয়ম অনুযায়ী রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছে।

এদিকে আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের চেযারম্যান নূরুল ইসলাম মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের অবস্থাকে নরকের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন, সেখানে গত প্রায় দেড় মাস ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে কমপক্ষে সাড়ে তিনশো জন নিহত হয়েছে।

Check Also

সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে দুবলার চরে গেলেন ৪০১জন পূণ্যার্থী

উপকূলীয় অঞ্চল (শ্যামনগর): পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে অনুমতি নিয়ে বঙ্গোপসাগরের দুবলার চরে রাস মেলায় গেছেন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।