ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রিপোট:: মগের মুল্লুকে নজিরবিহীন মুসলিম নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। সেখানে চলছে র্নিবিচারে গণহত্যা। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীদের নির্যাতন নির্মমতা ইতোপূর্বেকার সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে দাবি করা হয়েছে।
সৃষ্টি হয়েছে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির। নির্যাতনের ভয়াবহতা এতই ব্যাপকতর হয়েছে যে, সেদেশে বর্তমানে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা যেন জীবন্ত লাশ। আর যেসব রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে রাখাইন প্রদেশ ছেড়েছে এবং যেদিকে পারে পালিয়েছে যারা, তারাও অনাহারে ঝোপঝাড়ে, জঙ্গলে এবং মিয়ানমার সীমান্ত ছাড়িয়ে আত্মরক্ষা করেছে। রবিবার পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী গত ১০ অক্টোবর থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যে চিরুনি অভিযান চলছে তাতে প্রায় দেড়শ রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে। ধর্ষিত হয়েছে প্রায় অর্ধশত নারী। শত শত বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা পুরুষ ও যুবককে। এ অবস্থায় আগামী ২৩ ও ২৪ নবেম্বর অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। দুই দেশের স্থলসীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। ট্রানজিট পাস নিয়ে দুই দেশের জনচলাচলও স্থগিত রয়েছে। দিনের বেলা ছাড়া রাতের বেলায় নাফ নদীতে দুই দেশের জেলেদের মৎস্য শিকারও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। রাখাইন প্রদেশের মংডুতে দিনে-রাতে জারিকৃত কার্ফিউ অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তে বিজিবির টহল আরও জোরদার করা হয়েছে।
রাখাইন প্রদেশের মংডু জেলার উত্তরে ঘটনার ভয়াবহতা অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নতুন কোন ঘটনা নয়। প্রায় সাত দশক আগে থেকে সাবেক আরাকান (বর্তমান রাখাইন) প্রদেশে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের সূত্রপাত। নানান অজুহাতে ছলচাতুরিতে সে দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীরা বারবার হামলে পড়ছে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর। বর্বর অমানবিকতার সকল রেকর্ড ছাড়ানোর কথা বিশ্বজুড়ে পৌঁছে গেছে। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়েছে। অনুরোধও জানানো হয়েছে জাতিসংঘসহ বিশ্বের শক্তিশালী সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও অনুরোধকে উপেক্ষাই করে চলেছে। উপরন্তু রোহিঙ্গা নিধন অভিযানের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে রাখাইন যুবকরাও হামলে পড়ছে রোহিঙ্গা নর-নারীর ওপর।
সর্বশেষ গত ৯ অক্টোবর মংডুতে সে দেশের একটি সীমান্ত চৌকিতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাটের ঘটনার পর সন্দেহ করা হয় আরএসও সন্ত্রাসীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। পরদিন ১০ অক্টোবর থেকে শুরু হয় সেনাবাহিনীর চিরুনি অভিযান। এ অভিযান চালানো হচ্ছে সাধারণ নিরীহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর। ইতোমধ্যে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে প্রায় দেড়শ জনকে। ধর্ষণসহ বর্বর ঘটনাবলী এতই মর্মান্তিক যে, এসব ঘটনা পুরোপুরিভাবে মিডিয়ার কাছে পৌঁছছে না। মিডিয়া কর্মীদের সেখানে যেতেও দেয়া হচ্ছে না। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ট্রানজিট পাসের প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হয়েছে। বন্ধ রয়েছে সীমান্ত বাণিজ্য। নাফ নদীতে শুধু দিনের বেলায় দুই দেশের জেলেদের মাছ শিকারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রাতে মাছধরা সম্পূর্ণ বন্ধ।
প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী রাখাইন প্রদেশের মংডুর উত্তরে চলমান এ পরিস্থিতিতে প্রতিটি গ্রাম নারী-পুরুষ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টায় সীমান্তের কাছাকাছি জঙ্গলে অবস্থান করছে। সাহায্য সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে তাদের কাছে খাদ্য সামগ্রীও পৌঁছতে দেয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও রোহিঙ্গারা যাতে নতুন করে সীমান্ত গলিয়ে এদেশে আসতে না পারে এজন্য বিজিবির কড়া নজরদারি আরোপ করা হয়েছে। এরপরও ফাঁকফোকরে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা এদেশে আসছে এবং এ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কথাবার্তা ও চালচলনে কক্সবাজার অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিল থাকায় এদের চিহ্নিত করার সুযোগ বলতে গেলে নেই।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে ধর্ষণ করছে। গত শুক্রবার বিকেলে মংডুর উত্তরে কেয়ারিপ্রাং এলাকার তিন রোহিঙ্গা যুবতীকে ধর্ষণ করে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন। ওই গ্রামের কাছাকাছি স্থান ধুদাইং এলাকার একটি পাড়া শনিবার বিকেলে ঘিরে ফেলে সেনাসদস্যরা। পরক্ষণে যুবতী-কিশোরীদের প্রত্যেককে একেকটি ঘরে প্রবেশের জন্য বাধ্য করে। মহিলারা ঘরে প্রবেশ না করে ভয়ে এক স্থানে একত্রিত হয়। এদের মধ্যে থেকে ধুদাইং এলাকার হাজী করিমুল্লার মেয়ে ওয়াজেদা বেগমকে (১৭) নির্জন স্থানে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। রবিবার সকালে ওই কিশোরীর লাশ পাওয়া যায়।
ওপারের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গারা সেনাসদস্যদের অত্যাচার থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পাহাড়ের পাদদেশে বা লবণের মাঠে নিজেদের ব্যবহৃত কাপড়ের তাঁবু গেড়েছে। যেসব রোহিঙ্গা পরিবার পুরনো বসতভিটা ছেড়ে যায়নি, তাদের বাড়িঘরে গিয়ে তল্লাশির নামে সেনাসদস্যরা ঘর ও দোকানের মূল্যবান মালামাল-পণ্য লুট করার পাশাপাশি গৃহপালিত গরু-ছাগল পর্যন্ত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মংডুর উত্তরে হাতিরপাড়া, নাইছাপ্রাং, কেয়ারিপ্রাং, ধুদাইং, জাম্বুনিয়া, গৌজুবিল, রাম্ম্যাউবিল, কুজাবিল, রাহবাইল্যা, বুড়াসিকদারপাড়া, লংডুং ও বলিবাজার এবং রাচিদং জেলার মেরুংলোয়া, ধুংছে, ওয়াস্যং, রড়ছড়া, আন্দাং, কেয়ান্দং এলাকায় রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে বেশি। ওই সব এলাকায় শুক্রবার মসজিদগুলোতে জুমার নামাজ আদায় করতে অধিকাংশ রোহিঙ্গাকে যেতে দেয়া হয়নি।
সেনাসদস্যরা বৃহস্পতিবার থেকে দেশটির রাখাইন যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং দেয়া শুরু করেছে। এতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আরও বেশি ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনুরূপ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বৌদ্ধভিক্ষুদেরও। গত ১০ অক্টোবর থেকে বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ পর্যন্ত ১০টি পাড়ার ৪শ’ ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। নিহতের সংখ্যা সর্বশেষ ১৪০ জনে উন্নীত হয়েছে। খোদ ইউএনএইচসিআর থেকে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছেÑ ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে।
রাখাইন প্রদেশে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পালিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টার খবর সত্য নয় বলে দাবি করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। শনিবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদপত্রগুলো দাবি করেছে, আউং সান সুচির উপস্থিতি ও তার নির্দেশে গঠিত টাস্কফোর্স সদস্যরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার সত্যতা পায়নি। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী যেসব রোহিঙ্গাদের আটক করে ফেরত পাঠিয়েছে বলে দাবি করেছে তাও সত্য নয় বলেছে মিয়ানমার সরকার। তবে গত ৯ অক্টোবর ভোরে সহিংসতায় নিহতসহ পরবর্তীতে ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। নিহতদের তারা দাবি করেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী। তবে বেসরকারী বিভিন্ন সূত্রে মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে হামলার পর রাখাইন রাজ্যের মংডুর উত্তরে ১৩৯ জনকে হত্যা করা হয় বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। আউং সান সুচির গঠিত টাস্কফোর্স শনিবার আরাকানের মহকুমা শহর সিটওয়ে সফর করেছে। ড. ওহমিয়াউংয়ের টাস্কফোর্স সদস্যরা রাখাইন-রোহিঙ্গাদের মধ্যে সৃষ্ট অশান্তি নিয়ে তদন্ত শেষে আজ (সোমবার) মংডু এলাকা সফর করার কথা রয়েছে। মংডুতে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা এদেশে বসবাসরত আত্মীয়দের জানিয়েছে, মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা শত শত রোহিঙ্গা পুরুষদের ধরে নিয়ে গেছে। এদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে অমানবিক। তারা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে, তা জানা নেই।