ক্রাইমবার্তা ডেস্ক : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে পালিয়ে আসা অনেক রোহিঙ্গা বলেছেন, মিয়ানমারে থাকা মানে নিশ্চিত মৃত্যু, তাই তাঁরা বাংলাদেশেই থেকে যেতে চান।
বাংলাদেশ সরকার সীমান্তে কঠোর নজরদারি চালালেও বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় এসে আশ্রয় নিচ্ছেন রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলিমরা।
গত রোববার রাতেও নৌকায় করে টেকনাফের হ্নীলা এলাকায় এসেছেন অন্তত ১৩ জন রোহিঙ্গা। এদের সাথে কথা বলেছেন বিবিসির সংবাদদাতা আকবর হোসেন।
জানা গেছে, রাখাইনের সহিংস পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে রোববার রাতে একটি নৌকায় করে টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দেন অন্তত ২০ জন রোহিঙ্গা মুসলমান।
কিন্তু নাফ নদীর মাঝপথে তাদের নৌকা ডুবে যায়। তখন অন্য একটি নৌকা এসে তাদের বাঁচালেও ৭ জন যাত্রী এখনও নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজদের মধ্যে শিশুও রয়েছে।
প্রাণভয়ে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে আসার সময় তিন সন্তানকে হারিয়েছেন হুমাযুন কবির ও রোকেয়া বেগম।
হুমাযুন কবির বলেছেন, তিনি আর মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান না, যেভাবেই হোক বাংলাদেশেই থেকে যেতে চান তারা।
ওইখানে খারাপ ছিলাম না। কিন্তু এখন সেখানে যে পরিস্থিতি থাকার মতো অবস্থা আর নাই। ওইখানে ফিরে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু – বলছিলেন হুমাযুন কবির।
মি: কবির বলছেন, তাদের সাথে আরও অনেক রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কয়েকটি নৌকায় তারা রওনাও দিয়েছিল। কিন্তু তাদের এখন কী অবস্থা, জানেন না তিনি।
হুমায়ুন কবিরের ভাষ্য অনুযায়ী – মংডুতে তাদের গ্রামে আর কোনও রোহিঙ্গা মুসলিম খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবাই প্রাণভয়ে পালিয়ে আছেন কোথাও। নয়তো বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছে।
টেকনাফের হ্নীলা এলাকায় এসে আশ্রয় নিয়েছেন হুমায়ুন কবির, তাঁর স্ত্রী রোকেয়া বেগমসহ ১৩ জন।
তাদের সাথে আসা মোতায়রা বেগমও নাফ নদীতে তাঁর সন্তানকে হারিয়েছেন, নৌকায় আসার সময় মোতায়রার একমাত্র সন্তানও ডুবে গেছে।
হ্নীলায় এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন মোতায়রা ও তাঁর স্বামী।
মোতায়রা বেগম অভিযোগ করে বলেছেন রাখাইনে যে অত্যাচার-নির্যাতন চলছে তা বলে বুঝানো যাবে না।
সেনাবাহিনীর মানুষ এসে ঘরের দরজা আটকায়ে আগুন দেয় আর বলে এরা রোহিঙ্গা মুসলিম। কোনভাবে যদি কেউ বাড়ি থেকে পালাতে চায় তাহলে তারা গুলী করে।
রাখাইনের মেয়েদের ওপর ধর্ষণ-নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে বলে অভিযোগ করছেন এ রোহিঙ্গা মুসলিমরা।
রোহিঙ্গাদের প্রতি সরকারের কঠোর মনোভাব সত্ত্বেও সীমান্তের ওপারে চরম সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে পড়া মানুষদের প্রতি বাংলাদেশীদের সহানুভূতি বাড়ছে বলে বিবিসির সংবাদদাতা জানাচ্ছেন।
তবে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের দাবি বরাবরই অতিরঞ্জিত বলে বর্ণনা করে থাকে, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
বর্মী সরকারের একজন মুখপাত্র বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, রাখাইনে যা ঘটছে, তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
রোহিঙ্গাদের জন্যে দুনিয়ায় কেউ নেই ?
স্রেফ মুসলমান হওয়ার কারণে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা, নির্যাতন ও তাদের বাড়ি ঘরে আগুন দেয়া হচ্ছে। যদিও মিয়ানমার সরকার বলছে, রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের বাড়ি ঘরে আগুন দিচ্ছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন রোহিঙ্গা মুসলমানরা জান বাঁচাতে আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্তে এসে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করতে চাইলে তাদের ফের ফেরত পাঠাচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী। বাংলাদেশ এর আগেও বেশ কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এবার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। জাতিসংঘ রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় দেয়ার আহবান জানালেও তাতে কোনো কাজ হয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানী হানাদারদের হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে থাকার জন্যে ভারত গেলে দেশটি ১ কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থাকলেও বাংলাদেশ কিভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ফেরত পাঠায় এমন প্রশ্নও উঠেছে। আমাদের সময়.কম
প্রশ্ন হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্যে বাংলাদেশ এ যাবৎ অনেক কিছু করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্যে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কি করণীয় কিছু নেই? মানবতা বিচারের দিক থেকেও সীমান্তে কোনো দেশের নাগরিক আশ্রয় নিতে চাইলে তা বাধা দেয়া যায় না। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে যে লাখ লাখ মানুষ যুদ্ধ ও অন্যান্য কারণে ইউরোপ সহ অন্যান্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছে তা চাইলেও বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের অনেকে সাগরে ডুবে মারা গেছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের অনেকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড সহ অন্যান্য দেশে পাড়ি দিতে যেয়ে সাগরে ডুবে মারা গেছে। তারপরও মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নতুন করে হতাযজ্ঞ শুরু করেছে। অথচ মিয়ানমারের প্রতিবেশি প্রভাবশালী দেশ চীন, ভারত, থাইল্যান্ড সহ অন্যান্য বড় বড় দেশ বিষয়টি নিয়ে দেশটির উপর কোনো চাপ সৃষ্টি করছে না।
ইতিহাস বলে, এদেশে যখন বাঙালিদের উপর আর্য নিপীড়ন চলছিলো, আরাকানে আশ্রয় নেয় বাঙালিরা। কবি আলাওল থেকে শুরু করে অসংখ্য আশ্রয়প্রার্থীকে রোহিঙ্গারা আশ্রয়োর জন্যে দুয়ার খুলে দিয়েছিল। কোরেশী মাগন ঠাকুর থেকে নিয়ে অসংখ্য বাঙালির জন্য তারা সীমান্ত বন্ধ রাখেনি বা রাজসভায় তারা ঠাঁই পেয়েছিল। আজ রোহিঙ্গারা যে দুঃসময় পাড়ি দিচ্ছেন, এক সময় এদেশের বাঙালিরা সেন শাসনামলে আরাকানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অর্ধশত বছর পরেও যদি এদেশের নতুন প্রজন্ম যখন জানবে বাংলাদেশ একপর্যায়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যাযজ্ঞের মুখে আশ্রয় দিয়েও তারপর সীমান্ত থেকে তাদের ফেরত পাঠিয়েছিল? তখন তারা কি আমাদের ঘৃণা করবে না?
পরিষ্কার জাতিগত হত্যাযজ্ঞ চলছে মিয়ানমারে। মংডু এলাকার দক্ষিণ, নয়াপাড়া, বমুপাড়া, মাঙ্গালাপাড়া, সম্মন্যাপাড়া, চারমাইল, হাদির বিল ও ঝুড়ারপাড়া এবং আকিয়াবের নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, মং লেংপাড়া, বাহারছড়া, ছাক্কিপাড়া, জালিয়াপাড়া, রোহাইঙ্গা ও ওয়ালিদপাড়া সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ এ উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানি মুসলমানের বংশধর। এক সময় আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ’ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে।
১৬৬০ সালে আরাকান রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করেন। এরপর শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার-নিপীড়ন। প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর মুসলমানদের কাটাতে হয় এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে।
১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। সেও ছিল ঘোর মুসলিমবিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলিম নিধন করতে থাকে।
১৭৮৫ সালে ৩০ হাজার বার্মিজ সেনা আরাকান আক্রমণ করে মুসলমানদের মসজিদ ও বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। একই সঙ্গে তারা বহু রোহিঙ্গা মুসলমানকে পুড়িয়ে হত্যা করে এবং প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে।
১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের শাসনে চলে যায়। তখন মুসলমানরা কিছুটা স্বস্তিতে কাটালেও ১৯৩৭ সালে বার্মার স্বায়ত্তশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং তারা প্রায় ৩০ লাখ মুসলিমকে হত্যা করে।
১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। স্বাধীনতার পর পরই বার্মার সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং সরকারি পদে রোহিঙ্গাদের নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে মিয়ানমার থেকে মুসলিম বিতাড়নের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেন। তিনি নানাভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে ফায়দা লুটেন এবং মুসলিম নির্যাতনে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। ১৯৭০ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৭৪ সালে কেড়ে নেয়া হয় ভোটাধিকার। এরপর রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মূলে ১৯৭৮ সালে শুরু হয় অপারেশন ‘ড্রাগন কিং’।
এই অমানবিক অভিযানের পর রোহিঙ্গা মুসলমানরা অনেকে প্রতিবেশী মুসলিম দেশ বাংলাদেশের দিকে পাড়ি জমায়। তখন শুধু ১৯৭৮ সালে আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম বার্মার বৌদ্ধদের বর্বর আক্রমণের মুখে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে বাধ্য হয় শরণার্থী হিসেবে।
চীনের আশ্রয়ে ৩ হাজার রোহিঙ্গা
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের স্থানীয় ও সেনাবাহিনীর অত্যাচারে পালিয়ে বেড়ানো রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৩ হাজার জন আশ্রয় পেয়েছে চীনে। দেশটির গণমাধ্যমে সরকারের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের কিছু নাগরিককে চীনের মিয়ানমার সীমান্তাঞ্চলে আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের মূল আবাসস্থল থেকে চীনের সীমান্ত সবচাইতে দূরে। কিন্তু জীবন বাঁচানোর তাগিদে ছুটতে থাকা এই মানুষগুলো বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্ত ব্যবহার করে চীনে যাচ্ছে। চীনের সরকারের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়, তিন হাজার মিয়ানমারের নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছি আমরা, যাদের মধ্যে অনেকেই ছিল আহত। তাদের হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
চীন সরকারের বরাত দিয়ে ফার্স্ট পোস্ট জানায়, মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের যতটুকু সম্ভব সহায়তা দেয়া চেষ্টা করছে চীন।
এদিকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি মিয়ানমার সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছে চীন। তারা জানায়, চীন সীমান্তাঞ্চলে মিয়ানমারের গতিবিধির ওপর নজর রেখে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়াচ্ছে তারা।
এদিকে বাংলাদেশ ঢালাওভাবে সীমান্ত না খুললেও আশ্রয় দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের। ফার্স্ট পোস্ট জানায়, কমপক্ষে ৮৬ জনকে হত্যা ও ৩০ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করেছে মিয়ানমার সরকার। তাদের অনেকেই জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ ক্ষেত্রে আহত বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে বলে জানায় তারা। সূত্র : ফার্স্ট পোস্ট ও সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট