মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে দেশটির সরকারি বাহিনী। জীবন বাঁচাতে রাখাইন রাজ্যের হাজার হাজার রোহিঙ্গার দৃষ্টি এখন বাংলাদেশ সীমান্তে। মাথায় একটাই চিন্তা; কিভাবে নরককুণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা যায়? সেই নরক থেকে বেরিয়ে আসা একজন লালু বেগম। তার ভাষায়, ‘১০ বছরের অধিক বয়সের কোনো বালককে পেলেই তারা তাদের হত্যা করে। পুরুষদের সেনাবাহিনীর গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই নারী জানান, তাদের সম্প্রদায়ের নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হচ্ছে।
লালু বেগম ‘সেনাবাহিনী যখন আসে তখন আমরা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাই। আমি জানি না আমার স্বামী জীবিত আছেন নাকি তিনি মৃত।’
লালু বেগম বর্তমানে কক্সবাজারের কুতুপালং এলাকায় অবস্থান করছেন। তিনি সিএনএনকে জানান, তার গ্রামের বহু নারী সরকারি সেনাদের হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।
লালু বেগম বলেন, ‘তারা যখন কোনও সুন্দর নারী দেখে তখন তারা তাদের কাছে পানি চায়। এরপর তারা ঘরে ঢুকে তাদের ধর্ষণ করে।’
রাখাইন রাজ্যে আনুমানিক ১০ লাখ রোহিঙ্গার বাস। জাতিসংঘের ভাষায় এরা বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। এমনকি বংশ পরম্পরায় হাজার বছর ধরে সেখান বসবাস করে আসা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পর্যন্ত প্রদান করে না মিয়ানমার সরকার।
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহার করতে রাজি নয়। তারা এ সম্প্রদায়ের মানুষদের অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করে। অথচ বহু মানুষই মিয়ানমারে তাদের পূর্বপুরুষদের শিকড় প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
লালু বেগম বলেন, ‘আমাদের গ্রাম যখন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় তখন আমরা অন্য গ্রামে চলে যাই। অব্যাহতভাবে অবস্থান বদলাতে থাকি। এভাবে আসতে আসতে আমরা নদীতীরে আসি।’
তিনি বলেন, এই আসার পথে অনেকেই তাদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন।
লালু বেগমের ভাবী নাসিমা খাতুন সিএনএনকে বলেন, ‘যাত্রা শুরু করার সময়ে আমরা ছয়জন ছিলাম। আমরা পরিবারের তিন সদস্যকে হারিয়েছি। আমার স্বামী ও এক পুত্রকে হত্যা করা হয়েছে। আরেক পুত্র নিখোঁজ রয়েছে।’
জাতিসংঘ শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থার কর্মকর্তা জন ম্যাককেসিক বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশ রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর ‘যৌথ নিপীড়ন’ চালাচ্ছে। জাতিসংঘের হিসেবে সাম্প্রতিক সহিংসতায় ৮৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ।
জাতিসংঘের দাফতরিক সংজ্ঞা অনুযায়ী এথনিক ক্লিনজিং বা জাতিগত নিধন হলো সেই প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে ‘হুমকি দিয়ে অথবা শক্তি প্রয়োগ করে কোনও একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থেকে কোনও জাতিগত অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নির্মূল করে অপর কোনও জাতির একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়।’ আর তাদের হত্যা-ধর্ষণ-শিশু নির্যাতন-অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ ওই নির্মূল প্রক্রিয়ারই অংশ।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে মিয়ানমার সরকারের মদদপুষ্ট উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের তাণ্ডবে প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা নিহত হন। ঘর ছাড়তে বাধ্য হন ১ লাখেরও বেশি মানুষ। আর এ বছর অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এলাকায় সন্ত্রাসীদের সমন্বিত হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর তার দায় চাপানো হয় রোহিঙ্গাদের ওপর। আর তখন থেকেই শুরু হয় সেনাবাহিনীর দমন প্রক্রিয়া। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি, এরপর থেকেই রাখাইন রাজ্যে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইসলামি চরমপন্থা দমনে কাজ করছেন বলে দাবি করছেন তারা। আর তা এমন কঠোর প্রক্রিয়ায় চালানো হচ্ছে যে সেখানে সংবাদমাধ্যমকেও প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
রাখাইন রাজ্যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টির পরেও চলমান দমন প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অস্বীকার করে দায় এড়াতে চাইছে দেশটির সরকার। রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের বাড়িঘর পোড়াচ্ছে বলেও দাবি করছে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিশ্চিত করেই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেই চেনে। জাতিসংঘের অবস্থানও আলাদা নয়। সে কারণেই মিয়ানমারকে জাতিগত নিধন চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশ নীতিগতভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিরোধী হলেও এখানকার বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র উল্লেখ করে বিবিসি সাম্প্রতিক সংঘর্ষের কারণে হাজার হাজার রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আসার তথ্য নিশ্চিত করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে তারা জানিয়েছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আরও অনেক বিপন্ন মানুষ সীমান্তে অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশের চেষ্টায়।
শরণার্থী সংস্থার মুখপাত্র ম্যাককিসিক আরও বলেন, ৯ অক্টোবরে ৯ জন পুলিশ নিহত হওয়ার ঘটনায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষীরা মিলে ‘সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘবদ্ধ প্রতিশোধ’ নিচ্ছে। তারা দাবি করছে, রোহিঙ্গারাই ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
জন ম্যাককিসিক বিবিসিকে বলেন, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বাহিনী রাখাইন রাজ্যে ‘মানুষকে গুলি করে হত্যা করছে, শিশুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করছে, ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে, লুটপাট চালাচ্ছে, নদী পেরিয়ে তাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করছে’।
‘এখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বলা খুব কঠিন যে তারা সীমান্ত উন্মুক্ত করে রেখেছে। কেননা এতে মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নিধন প্রক্রিয়াকেই ত্বরান্তিত করা হবে। চূড়ান্ত অর্থে রোহিঙ্গাদের নির্মূল করার লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা হত্যাকাণ্ড এবং তাদের বিতাড়ন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবে।’ বিবিসিকে বলেন ম্যাককিসিক।
বুধবার বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়ে ভর্ৎসনা করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাখাইন রাজ্যে সেনা দমনকে ‘গভীর উদ্বেগ’-এর বিষয় হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ৪০ দিন ধরে রাখাইন রাজ্যে অবরুদ্ধ হয়ে থাকা ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ত্রাণসংস্থাগুলো। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা এই ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয় করছেন। ‘আমাদের সহায়তার মূল উদ্দেশ্য হলো তারা যেন বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য না হয়।’ সম্প্রতি রয়টার্সকে বলেন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার একজন মুখপাত্র। তবে তারপরও যারা নিতান্তই বাধ্য হয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন, বাংলাদেশকে তাদের জন্য মানবিক সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার। রাখাইনে নতুন করে গঠিত ইনফরমেশন টাক্সফোর্স-এর সদস্য এবং প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র জ তাই দাবি করেন, এ নিয়ে তারা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের কোনও আলামত তারা পাননি। সূত্র: বিবিসি, সিএনএন।