ক্রাইমবার্তা রিপোট:ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ সরকারিকরণের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ, টিয়ারসেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জের ঘটনায় কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালামসহ (৫৫) দু’জনের মৃত্যু এবং শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। দফা দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় সফর আলী (৬০) নামের এক বৃদ্ধ মারা যান। আন্দোলনকারিদের সাথে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও সংঘর্ষের ঘটনায় উপজেলা সদর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ ১০/১৫ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়ে। রোববার দুপুরে ফুলবাড়িয়া উপজেলা সদরে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর কলেজ ও উপজেলা পরিষদের আশপাশের দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে উপজেলা সদরে এক প্লাটুন র্যাব ও পাঁচ প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজকে জাতীয়করণ না করে কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এমপিওবিহীন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা মহাবিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করায় ফুঁসে উঠে এলাকাবাসী। তারা ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ জাতীয়করণের দাবি জানায় এবং দেড় মাস ধরে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে লাগাতার আন্দোলন করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। চলমান আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত ২৪ নভেম্বর বিকেলে চার ঘণ্টা ফুলবাড়িয়া-ময়মনসিংহ সড়ক অবরোধ করে। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারিরা ক্ষিপ্ত হয়ে স্থানীয় এমপির এক অনুষ্ঠানের মঞ্চে হামলা চালায় এবং ২০/২৫টি মোটরবাইক ভাঙচুর করে। একই সময় আন্দোলনকারিরা হাসপাতাল রোডের আখালিয়া হেলথ সেন্টারে হামলা চালিয়ে গ্লাস, আসবাবপত্র, অ্যাম্বুলেন্স ও দু’টি প্রাইভেটকার ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় পুলিশ থানায় মামলা দায়ের করে। ওইদিন একজনকে আটক করা হয়। এরই প্রতিবাদে রোববার দুপুর দু’টোর দিকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করতে চাইলে পুলিশ প্রধান ফটকেই আটকে দেয়। এসময় আন্দোলনকারীরা কলেজের সামনে সড়ক অবরোধ করে এবং বিকেল পর্যন্ত অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। একপর্যায়ে পুলিশ কলেজের প্রশাসনিক ভবনে ঢুকে শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পেটায় এবং এক শিক্ষার্থীকে আটক করলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় কলেজ ও উপজেলা পরিষদ এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শিক্ষার্থীরা পুলিশের প্রতি বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে দফা দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। সংঘর্ষের সময় উপজেলা পরিষদের সামনে এক বৃদ্ধ পথচারি সফর আলী (৬০) উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন। সেখান থেকে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সফর আলীকে মৃত ঘোষণা করেন। তার বাড়ি উপজেলার কুশমাইল কড়ইতলায়। সে ভ্যানচালক বলে জানা যায়। তার এক আত্মীয় কমলার অভিযোগ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার সময় পুলিশ তাকে লাঠিপেটা করে। সফর আলী পুলিশের গাড়ির পাশেই রাস্তায় পড়েছিল।
এদিকে কলেজের প্রশাসনিক ভবনে পুলিশের লাঠিচার্জের সময় ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক আবুল কালাম আহত হলে তাকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চুরখাইয়ে কমিউনিটি বেইজড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার বাড়ি জেলার নান্দাইল উপজেলায়। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। ফুলবাড়ীয়া কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ইমাম হোসেন জানান, কলেজের অফিস রুমে ঢুকে পুলিশ শিক্ষকদের বেধড়ক লাঠিপেটা করেছে। এ সময় শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ অজ্ঞান হয়ে যান। তাকে ময়মনসিংহের চুরখাই কমিউনিটি বেজড মেডিকেল হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। তিনি আরো জানান, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ চারটি মামলা দায়ের করে দুই শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে এবং শিক্ষার্থীদের হয়রানি করছে। এ পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতারও করেছে। ঘটনার সময় জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন কমিটি আহবায়ক সহকারি অধ্যাপক আবুল হাশেম, সহকারি অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন, সহকারি অধ্যাপক উপেন্দ্র চন্দ্র, সহকারি অধ্যাপক ফজলুল হক, প্রভাষক রুমা আখতার, শিক্ষার্থী আসাদ, কামাল ও রুবেল আহত হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
ফুলবাড়িয়া কলেজ সরকারিকরণ দাবি আদায় কমিটির আহবায়ক এস এম আবুল হোসেন ও যুগ্ম-আহবায়ক রুহুল আমীন সাংবাদিকদের জানান, পুলিশ কলেজের প্রশাসনিক ভবনে প্রবেশ করে শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পিটিয়েছে। এসময় পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে।
ফুলবাড়িয়া থানার ওসি রিফাত খান রাজিব দাবি করেন, আন্দোলনকারিদের মিছিলে পুলিশ বাঁধা দিলে মিছিলকারিরা বিকেল পর্যন্ত অবরোধের ঘোষণা দেন। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারিরা কলেজ থেকে বের হয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। তবে মৃত্যুর সাথে লাঠিচার্জের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অবশ্য মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আন্দোলনকারীরা গুজব ছড়াচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
সন্ধ্যায় পুলিশ সুপার সৈয়দ মো. নুরুল ইসলাম ১৫/২০ রাউ- রাবার বুলেট ও টিয়ার সেল নিক্ষেপের কথা স্বীকার করে সাংবাদিকদের জানান, সন্ধ্যা নাগাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। দু’জনের মৃত্যুর সাথে এ ঘটনার কোনো যোগসূত্র নেই। নিহত দু’জনই অসুস্থ ছিল বলেও দাবি করেন তিনি।
এদিকে উপজেলা সদরে এক প্লাটুন র্যাব ও পাঁচ প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন রয়েছে বলে অপর এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান। তবে এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।