ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রিপোট:চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী ও গ্রামপুলিশের (চৌকিদার) অনুকূলে বরাদ্দের নামে শত শত কোটি টাকার সরকারি খাদ্যশস্য হরিলুট হচ্ছে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির অংশ হিসেবে কম দামে সরবরাহের লক্ষ্যে ‘ফেয়ার প্রাইস কার্ডের (এফপিসি)’ আওতায় সরকারি কর্মচারীদের ওই খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। প্রায় ছয় বছর ধরে সরকারি দল-সমর্থিত ৫৪৬ ডিলার প্রতিমাসে তালিকাভুক্ত কর্মচারীদের এ বরাদ্দ লুট করছেন। প্রতিমাসে সরবরাহ করা হয় ৯৪৩ টন চাল, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। সে হিসাবে আলোচ্য সময়ে সরকারি কোষাগার থেকে বেরিয়ে গেছে ২৫০ কোটি টাকারও বেশি।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, নিয়মের আওতায় ফেলে বছরের পর বছর এই অনিয়ম চললেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। এ সময় অনেক কর্মচারী মারা গেছেন, বদলি ও অবসরেও গেছেন। বিস্ময়কর হলোÑ ২০১১ সালের পর থেকে সরবরাহকৃত কার্ড আজও কেন হালনাগাদ করা হয়নি, সে উত্তর দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে ৪৭ হাজার ১৬৩ সরকারি কর্মচারীর পরিবারের নাম দেখিয়ে প্রতিমাসে ১১.৫০ টাকা কেজি দরে ৯৪৩ টন চাল তুলছে ৫৪৬ ডিলার। এর বাজারমূল্য ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৮২ হাজার টাকা। ভোক্তাদের কাছে এই চাল ১৩.৫০ টাকা কেজিদরে বিক্রি করার কথা।
সচিবালয়ে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী সমিতিসূত্রে জানা যায়, ৫ শতাংশ কর্মচারীও ওই চাল নেন না। ফলে প্রায় পুরোটাই কালোবাজারে চলে যায়। মাঠপর্যায়ের চিত্র আরও ভয়াবহ। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার অন্তত ৩০ ইউনিয়নের চৌকিদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা এই কর্মসূচির নামও শোনেননি। অথচ তাদের নাম ব্যবহার করেই কোটি কোটি টাকার সরকারি চাল লোপাট করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ৪র্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের অনুকূলে বরাদ্দ তুলতে ঢাকায় ১৩৪, চট্টগ্রামে ১১২, রাজশাহীতে ৭৬, রংপুরে ৬২, খুলনায় ৬৭, বরিশালে ৪৬, সিলেটে ৪৩ ও ঢাকা রেশনিংয়ে ছয় ডিলার বহাল রয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তৎকালীন মহাজোট সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ভর্তুকি দিয়ে কম দামে ৮০ লাখ পরিবারকে সরকারি খাদ্য সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে স্বল্প ও সীমিত আয়ের জনগোষ্ঠীকে কম দামে খাদ্যপণ্য সরবরাহের লক্ষ্যে ‘ফেয়ার প্রাইস কার্ড (এফপিসি)’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একই সময়ে ৪র্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী ও চৌকিদারদের এ কর্মসূচির আওতায় নেওয়া হয়। তালিকাভুক্ত করা হয় তিন লাখ এক হাজার ৪র্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর নাম। তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এক লাখ ৪৪ হাজার ৫৪৮টি কার্ড। ঘটা করেই রাজধানীসহ দেশের সব ইউনিয়ন-উপজেলা ও জেলায় দরিদ্রবান্ধব এ কর্মসূচি চালু করা হলেও মাস তিনেক পর এফপিসির অন্য কার্যক্রম স্থগিত করে শুধু ৪র্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের কম দামে খাদ্য সরবরাহ চালু রাখে সরকার।
খাদ্য বিভাগসূত্র জানায়, তালিকাভুক্ত ৮০ লাখ পরিবার এই সুবিধাবঞ্চিত হলেও তিন লাখ সরকারি কর্মচারীদের জন্য কম দামে খাদ্যশস্য অদ্যাবধি চালু রাখা হয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বদরুল হাসান এ প্রসঙ্গে জানান, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির নানাদিক পর্যবেক্ষণ করেছি। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে। এ অবস্থায় সরকারি কর্মচারীদের ক্ষুদ্রাংশের জন্য ভর্তুকি দিয়ে কেনা এ খাদ্য সরবরাহ কার্যক্রম অব্যাহত রাখার কোনো দরকার আছে বলে মনে করি না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, এ ধরনের কর্মসূচিগুলো রাজনৈতিক দোষে দুষ্ট হয়ে পড়েছে। প্রকৃত গরিব মানুষকে সহায়তা করতে হলে রাজনৈতিক প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সরকারের উদ্যোগ ভালো। কিন্তু দোষীদের শাস্তি না হওয়া এবং কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় এসব ভালো উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে।
এদিকে সরকারিভাবে ৯৬টি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি চললেও সমন্বয় ও মনিটরিংয়ের অভাবে কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমুন্নয়নের এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রধান ত্রুটিগুলো হচ্ছে উপকারভোগী শনাক্তকরণে গাইড লাইন অনুসরণ না করা, দুর্নীতি-রাজনীতিকরণ, কার্যকর মনিটরিংয়ের অভাব, সমন্বয়হীনতা এবং স্থানভেদে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকে গুরুত্ব না দেওয়া। এ ছাড়া পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।