মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এখনো সরব নয় বিশ্ব সম্প্রদায়

রাখাইন রাজ্যের মানবিক সংকট নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায় যেমন সরব নয়, তেমনি আঞ্চলিকভাবেও বিষয়টি নিয়ে কেউ সোচ্চার হয়নি। এর মধ্যে ব্যতিক্রম শুধু মালয়েশিয়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের অন্যতম প্রভাবশালী দেশটির মন্ত্রিসভা শুক্রবার রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিধনের যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি বন্ধ করতে মিয়ানমারকে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে বলেছে মালয়েশিয়া। শুক্রবার মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।
গতকাল শনিবার ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনের কূটনৈতিক সূত্রগুলোতে যোগাযোগ করে জানা গেছে, শুক্রবার মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানে বিপুলসংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটে। সেনাবাহিনীর একটি দল রাখাইনের হাতিপাড়ায় অভিযান চালিয়ে ২৫-৩০ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। অন্তত ৩৫-৪০ জন গুলিতে গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযানে রাজ্যটিতে এক দিনে এটি সর্বোচ্চ হতাহতের ঘটনা। তবে কূটনৈতিক সূত্রগুলো শুক্রবার এক দিনে বিপুল হতাহতের খবর জানালেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি।
আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ও টেকনাফ প্রতিনিধি জানান, রাখাইনের বাউলিবাজারের কাছে হাতিপাড়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নতুন অভিযান শুরুর পর শুক্রবার থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশের জন্য রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি বেড়েছে। গতকালও হাতিপাড়ায় রোহিঙ্গাদের হত্যার খবর জানিয়েছেন সেখান থেকে পালিয়ে আসা লোকজন।
গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর অনুরোধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশকে সহযোগিতার আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহের জায়গা শুধু মানবিক সহায়তায়। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে মানবিক সহায়তা ও আশ্রয়ের প্রসঙ্গে তাঁরা কথা বলেছেন। অথচ রাখাইন রাজ্যের সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারকে মূল উৎসে যেতে হবে, তা নিয়ে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা কথা বলেননি।
ব্রিফিংয়ে উপস্থিত এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারকেই উৎসে গিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার কথা আর বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দিতে বলছে। রাখাইনের সমস্যা মেটাতে হলে মিয়ানমারকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে। এ জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
ওই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত দুই কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, রোহিঙ্গাদের সমস্যা মিয়ানমারে হলেও এটির রেশ বাংলাদেশের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে বলে মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্তত তিনজন পশ্চিমা কূটনীতিক। রাখাইনে এবার কেন এত ব্যাপক আকারে সহিংসতা চলছে, এ নিয়ে বাংলাদেশের বিশ্লেষণও জানতে চান কয়েকজন কূটনীতিক।
বাংলাদেশের কূটনীতিকদের মতে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমার মোটেই আন্তরিক নয়। এ বিষয়ে চীনের সঙ্গে সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের শান প্রদেশের সাম্প্রতিক সহিংসতার প্রসঙ্গ টানেন তাঁরা। শান প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় গত সপ্তাহে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত হন। কিছু লোকজন সীমান্ত পেরিয়ে চীনে ঢোকে। শান প্রদেশের সীমান্তে ওই সংঘাতের পরপরই চীনের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছে মিয়ানমার। অথচ গত ৯ অক্টোবর রাখাইনে সহিংসতা শুরুর পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে এখনো আলোচনায় বসেনি মিয়ানমার।
ইইউ রাখাইনে নিরাপত্তা ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। রাখাইনে প্রাথমিক হামলা এবং ওই হামলার পর সেনাবাহিনীর অভিযান—দুটি ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের জন্য আবারও আহ্বান জানায় ইইউ। পাশাপাশি সেখানকার লোকজনের মানবিক সহায়তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণকর্মীদের আবার ওই এলাকায় যাওয়ার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানানো হয়।
মিয়ানমারের নতুন রাজধানী নেপিডোতে শেষ হওয়া মিয়ানমার-ইইউ তৃতীয় নিরাপত্তা সংলাপ শেষে শুক্রবার প্রচারিত যৌথ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এদিকে রাখাইনে সহিংসতার কারণে শিগগিরই মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিফাহ আমান। এ ছাড়া মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানাতে কুয়ালালামপুরে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত জ মিন্টকে তলব করতে যাচ্ছে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।