কক্সবাজার (দক্ষিণ) সংবাদদাতা
আরাকানকে রোহিঙ্গা মুসলমানশূন্য করতে নানা অজুহাতে প্রদেশটিতে ১৯ বার অভিযান চালায় মিয়ানমারের বর্বর বাহিনী। ১৯৪২ সাল থেকে চলা এই দমন-পীড়ন নির্যাতনে আরকান এখন বিধ্বস্ত এক জনপদ। এ কারণে বাংলাদেশে বাড়ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা। শরণার্থীদের এই চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বিজিবি ও কোস্ট গার্ড।
বিজিবি কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানিয়েছেন, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টাকালে রোহিঙ্গা ভর্তি ছয়টি নৌকা ও পাঁচজনকে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। রোববার ভোররাতে উখিয়া ও টেকনাফের নাফ নদীর বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে তাদের ফেরত পাঠনো হয়। গত ১ নভেম্বর থেকে গতকাল সকাল ৭টা পর্যন্ত ৪১৬ অনুপ্রবেশ চেষ্টাকারী রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বিজিবি টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর আবু রাসেল সিদ্দিকী বলেন, রোববার ভোররাতে নাফ নদীর বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টাকালে জলসীমার শূন্যরেখা থেকে রোহিঙ্গা বোঝাই ছয়টি নৌকা ফেরত পাঠানো হয়েছে। প্রতি নৌকায় ১০ জনের বেশি রোহিঙ্গা ছিল।
১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সামরিকের জারিকৃত নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে তিনটি ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হয়। (১) তাইরেন্স (প্রথম শ্রেণীর নাগরিক), (২) নাইংচা (প্রাকৃতিক নাগরিক), (৩) নাইংক্রাচা (অতিথি নাগরিক); কিন্তু এই তিন ক্যাটাগরির কোনোটিতেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। সর্বশেষ তাদের দেশবিহীন জাতিতে পরিণত করতে গত ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মুসলিম অধ্যুষিত সীমান্ত চৌকিতে পুলিশের ওপর হামলায় ঘটনার সূত্রপাত ধরে শুরু হয় অভিযানের নামে মিয়ানমারের সরকারি তিন বাহিনী পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সীমান্তরী বাহিনীর নৃশংসতা। নৌ, স্থল, আকাশপথে চলছে থেমে থেমে নৃশংস আক্রমণ। ফলে রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসছেন। নাফ নদী ও সাগরে ভাসছে নারী-পুরুষ ও নিরীহ মানুষ বোঝাই অনেক নৌকা। রোহিঙ্গারা কোনোভাবেই যাতে এ দেশে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বিজিবি ও কোস্ট গার্ড সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।
মংডুর জামবুনিয়া রাঙ্গাবালি গ্রামের বিধবা ফাতেমা খাতুন (৫৩) জানালেন নরককুণ্ড থেকে বেরিয়ে আসার ঘটনা। জানালেন, স্বামীকে হারিয়েছেন অর্ধযুগ আগে। রাখাইন প্রদেশে বসবাস হলেও নাগরিকত্ব মিলেনি। এরপরও সন্তান ও নাতি-নাতনী নিয়েই দিন কাটছিল; কিন্তু সেই সুখ তাদের শোকে পরিণত হয়েছে। সব কিছু হারিয়ে তিন নাতনীকে নিয়ে তিনি এখন দেশান্তরী। স্বীকৃতি মিলেছে অবৈধ অভিবাসীর। তিনি বলেন, গ্রামে সেনাসদস্যরা আক্রমণ চালায় ১৫ নভেম্বর রাতে। বাড়িতে ঢুকে ছেলে শাহ আলম (৩০), নুর ছালাম (২৭), আমান উল্লাহ (২৫) ও হামিদ হোসেনকে (১৬) বেঁধে ফেলে। এরপরই চলে তার দুই মেয়ের ওপর পাশবিক নির্যাতন। একে একে সেনারা তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
ফাতেমা বলেন, ‘নির্যাতনে বাধা দেয়ায় সেনারা মারধর শুরু করে। মেয়েদের ওপর নির্যাতন শেষ হলেই চার ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে ঘরে আগুন দেয় সেনাসদস্যরা। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে কে কোথায় গেছে আমি জানি না।’
নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা শরণার্থীদের
হুমায়ুন কবির জুশান উখিয়া (কক্সবাজার) জানান, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। আশ্রয়হীন হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু বাংলাদেশে চলে আসার জন্য সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে ওঁৎপেতে অপেক্ষা করছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবির কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকার পরও থেমে নেই অনুপ্রবেশ। গত দুই সপ্তাহে উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প ও তৎসংলগ্ন রোহিঙ্গা বস্তিতে কমপক্ষে ১০ হাজার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন বলে শরণার্থী ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে। তাদের মুখ থেকে মিয়ামারের সেনাসহ বিভিন্ন বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নের রোমহর্ষক বর্ণনা শোনা গেছে।
গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের মংডুর পার্শ্ববর্তী এলাকায় তিনটি সেনাক্যাম্পে সশস্ত্র হামলায় ৯ সেনাসদস্য নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সে দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও রাখাইন জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাসরত ফয়সাল আনোয়ার জানান, ১১ নভেম্বর হতে এ পর্যন্ত মংডুর নাইচাপ্রু, হাস্যেরপাড়া, সাতগরিয়া পাড়া, খেয়ারীপ্রাং, ওয়াবেক, নাকপুরা, লোদাইং, কাউয়ারবিল, ধুংছেপাড়া, বড় গৌজবিল, ছোট গৌজবিলসহ প্রায় ১৮টি গ্রামে লুটপাট, ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন ছাড়াও ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। পুরুষদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। বহু নারীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করছে সেনারা। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারীরা জানিয়েছেন সেসব তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তাদেরই একজন রুবাইয়া (২৪) জানান, দুর্বৃত্তরা তাকে ও তার ছোট বোন সাবিহাকে (১৭) বিছানার সাথে বেঁধে রেখেছিল। এরপর এক এক করে সেনা এসে তাদের ধর্ষণ করেছে। এরপর তাদের ঘরে আগুন দিয়ে চলে যায় সেনারা। এর আগেই তাদের বাবাকে হত্যা করা হয়।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এলেও সেই আতঙ্ক এখনো তাদের তাড়া করছে। সেনাদের অত্যাচারের বিবরণ দিতে গিয়ে যন্ত্রণায় কুকড়ে যাচ্ছিল ওই তরুণীর মুখ। পাশে বসে ছিল তার দুই ভাইবোন, তারাও সেনাদের অত্যাচারের সাী। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসাদের অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছেন উখিয়ার কুতুপালং বস্তিতে। রুবাইয়ার ছোট ভাই আব্দুল হাসেম জানিয়েছেন, সেখানে তাদের বহুদিন উপবাসে কাটাতে হয়েছে।
রুবাইয়া জানান, সেনারা চলে যাওয়ার আগে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল এরপর তাদের দেখতে পেলে খুন করা হবে। রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে তাড়াতেই সেনারা তাদের ওপর শারীরিক অত্যাচার চালাচ্ছে, গণহারে ধর্ষণ করছে। এমন একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে যেন উদ্বাস্তুরা ভয়ে পালিয়ে যায়।
কুতুপালং বস্তিতে আশ্রয় নেয়া খেয়ারীপ্রাং গ্রামের আলী আহমদ (৬৫) জানান, তার স্ত্রী, ছেলেসহ পরিবারের সাত সদস্যের মধ্যে ছয়জনের কোনো খোঁজ না পেয়ে তিনি এই বস্তিতে চলে আসেন। তিনি জানান, তার মতো হাজার হাজার রোহিঙ্গা দেশে আসার জন্য সীমান্তে অপেক্ষা করছেন।
কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক জানান, বিজিবি-পুলিশের সতর্ক অবস্থানের পরও প্রতিদিনই কুতুপালং বস্তি ও শরণার্থী শিবিরে ঢুকছে রোহিঙ্গারা। তিনি জানায়, এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা কারো না কারো আত্মীয়স্বজন হওয়ার সুবাদে তাদের অনুপ্রবেশের খবর অনেকটাই গোপন থেকে যাচ্ছে বলে কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জ শাকিল আরমান জানিয়েছেন। উখিয়া থানার ওসি মো: আবুল খায়ের জানান, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধের পাশাপাশি এখানকার বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ পল্লীতে পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানান, সীমান্তে বিজিবি সদস্যদের কড়া নিরাপত্তার কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কমেছে। তবে রাতে সীমান্তের বিভিন্ন ফাঁক-ফোকর দিয়ে কিছু রোহিঙ্গা এসে কুতুপালং বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে। গতকাল অনুপ্রবেশকারী ৫ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে তিনি জানান।
শীতে কাঁপছেন রোহিঙ্গারা : উখিয়া-টেকনাফের মানুষ বিশেষ করে সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতিত রোহিঙ্গারা তীব্র শীতে কাঁপছেন। উখিয়া প্রেস কাবের সাবেক সভাপতি রফিক উদ্দিন বাবুল জানান, সংবাদ সংগ্রহ করতে কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট শিশুটি তার দাদীর কোলে তীব্র শীতে কাপছে। শিশুটির পরনে নেই জামাকাপড়। অসহায় রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে মানবাধিকারকর্মী, সরকার ও এনজিওগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।