হাইকোর্টে নির্বাচন কমিশনের নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা

ক্রাইমবার্তা রিপোট:ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সংক্ষুব্ধ প্রার্থীদের অভিযোগের নিষ্পত্তি না করে তাঁদের আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়ার খেসারত দিল নির্বাচন কমিশন। সংক্ষুব্ধ এক প্রার্থীর দায়ের করা মামলায় হাইকোর্ট বলেছিলেন, কমিশন প্রার্থীদের অভিযোগ নিষ্পত্তি না করে উপদেশ দিয়ে আদালত অবমাননা করেছে। এ ঘটনায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)সহ পাঁচ কমিশনার আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। একজন কমিশনার ও কমিশনের এক আইনজীবী এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ, মো. জাবেদ আলী, মো. শাহনেওয়াজ

হাইকোর্ট বলেছিলেন, অভিযোগের নিষ্পত্তি না করে প্রার্থীদের আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে নির্বাচন কমিশন একটি আধা ফৌজদারি অপরাধ করেছে। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কমিশনার আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ, জাবেদ আলী ও মো. শাহনেওয়াজ গত শনিবার সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে সশরীরে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন জমা দেন। হলফনামা আকারে জমা দেওয়া নিজেদের বক্তব্যে কমিশন বলেছে, আদালতের আদেশটি তারা বুঝতে পারেনি। যে কারণে তারা ভুলবশত ভিন্নরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছে। ভুলকে অনিচ্ছাকৃত উল্লেখ করে ভুলের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছে কমিশন। বলেছে, ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুল আর হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ প্রথম আলোকে বলেন, তখন ইউপি নির্বাচন চলছিল। তাড়াহুড়োর মধ্যে হাইকোর্টের নির্দেশের বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। উল্টো ভুল করে প্রার্থীদের আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এতেই আদালত ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বলেছেন, কমিশনকে অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছিল, উপদেশ দিতে বলা হয়নি। মূলত এখানেই ভুল হয়েছে। সে জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়েছে।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের অভিযোগের প্রতিকার না করে উপদেশ দেওয়ার খেসারত

জানা গেছে, ব্যাপক সহিংসতা, প্রাণহানি ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে গত ২২ মার্চ ৭১২টি এবং ৩১ মার্চ ৬৩৯টি ইউপিতে প্রথম দুই পর্বের ভোট গ্রহণ করা হয়েছিল। এতে বেশ কিছু এলাকার নির্বাচনী অনিয়ম সম্পর্কে কমিশনের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তারা ব্যবস্থা নেয়নি। চাঁদপুরের হাইমচর, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডসহ আরও অনেক জায়গায় ভোটের দিন নির্বাচনী অনিয়মের খবর কমিশন যথাসময়ে পেয়েছিল। কিন্তু সাচিবিক কাজে বিলম্বের কারণে তারা অবৈধ ভোট গ্রহণ বন্ধ করতে পারেনি। এসব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংক্ষুব্ধ প্রার্থীরা প্রতিকার চেয়ে নির্বাচন কমিশনে হাজারের বেশি আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কমিশন সেসব অভিযোগ আমলে নেয়নি।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী জাহিদুল ইসলাম হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট নির্বাচন কমিশনকে অভিযোগটি নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। কিন্তু কমিশন হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে ২৩ এপ্রিল এক চিঠির মাধ্যমে সব সংক্ষুব্ধ প্রার্থীকে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। এ বিষয়ে ২৩ এপ্রিল প্রথম আলোতে ‘ইউপি নির্বাচনে হাজার অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন আদালতে যেতে বলেছে, অভিযোগের সুরাহা হয় না’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আইনে বলা তফসিল ঘোষণার পর থেকে গেজেট প্রকাশের আগ পর্যন্ত নির্বাচনকালীন সময়। এ সময়ের মধ্যে যেকোনো ধরনের অনিয়মের বিষয়ে সংক্ষুব্ধ প্রার্থীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করে নির্বাচন বা নির্বাচনের ফল বাতিল করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের। কমিশনের ওপর অর্পিত এই ক্ষমতার কথা সংবিধানেও বলা আছে। কমিশন নিজেদের এই ক্ষমতা প্রয়োগ না করে ভুল করেছে।
কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, কমিশন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনী আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই ধারায় বলা আছে, গৃহীত নির্বাচন বিষয়ে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ব্যতীত অন্য কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষের কাছে আপত্তি উত্থাপন করা যাবে না। প্রার্থী ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি নির্বাচন বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন না।
যদিও এ বিষয়ে কমিশন সচিবালয়ের আইন শাখা ভিন্নমত পোষণ করে নথি উত্থাপন করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ২৩ ধারায় বলা আছে, নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল থাকবে। নির্বাচনী ফলের গেজেট প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে সংক্ষুব্ধ প্রার্থীকে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে। ট্রাইব্যুনাল দরখাস্ত দায়েরের ১৮০ দিনের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করবেন। কিন্তু নির্বাচন পরিচালনা বিধির ৫৩ ধারায় বলা আছে, নির্বাচনে নির্বাচনী দরখাস্ত করা ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। প্রতিদ্বন্দ্বী যেকোনো প্রার্থী নির্বাচনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কমিশনে আবেদন করতে পারবেন। নির্বাচন পরিচালনা বিধির ৯০ ধারায় বলা আছে, সন্তোষজনক মনে না হলে কমিশন নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে নির্বাচন-প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে পারে। এমনকি ফলাফল বাতিলের ক্ষমতাও আছে।
আইন শাখা থেকে বলা হয়েছিল, আইনের ২২ ও ২৩ ধারার সঙ্গে বিধির ৫৩ ও ৯০ ধারা একসঙ্গে মিলিয়ে পড়লে আইনের ব্যাখ্যা ভিন্নরূপ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে কমিশনকে অভিযোগ আমলে নিয়ে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। কিন্তু কমিশন তাদের আইন শাখার সেই মতামতকে উপেক্ষা করে প্রার্থীদের আদালতে যাওয়ার উপদেশ দেয়। এ বিষয়ে ১৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছেন, হাইকোর্ট জাহিদুল ইসলামের অভিযোগ নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও কমিশন তা আমলে না নিয়ে আদালত অবমাননা করেছে। নির্বাচনে ফলের গেজেট প্রকাশের আগ পর্যন্ত অভিযোগ আমলে নিয়ে নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা কমিশনের। কিন্তু তারা নিজেদের সেই ক্ষমতা প্রয়োগ না করে প্রার্থীদের উপদেশ দিয়েছে। প্রার্থীদের আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা কমিশনের আছে, কিন্তু উপদেশ দেওয়ার ক্ষমতা নেই।
হাইকোর্ট এই ভুলের জন্য পুরো কমিশনকে সশরীরে হাজির হয়ে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে কমিশন সচিবালয়ের আইনজীবী মোহাম্মদ ইয়াসিন খান এই নির্দেশ শিথিল করে প্রতিনিধির মাধ্যমে কমিশনের বক্তব্য উপস্থাপনের আরজি করেন। এতে আদালত বলেন, সুযোগ নেই। কারণ, কমিশন আধা ফৌজদারি অপরাধ করেছে। জানতে চাইলে ইয়াসিন খান প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী কমিশন সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজেদের বক্তব্য হলফনামা আকারে হাইকোর্টে জমা দিয়েছে। এখন শুনানির দিন তা হাইকোর্টে উপস্থাপন করা হবে। এ জন্য কমিশনারদের সশরীরে হাজির থাকতে হবে না।

Check Also

প্রত্যেকটা অফিসের কেরানি পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের দোসর : আসিফ মাহমুদ

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।