আলফাজ আনাম:স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে এর স্বাভাবিক কার্যক্রম এখন অনেকটা ভেঙে পড়েছে। স্থানীয় সরকারে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ঠেকাতে ও কোণঠাসা করতে সরকারের মরিয়া প্রচেষ্টার কারণে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব আর থাকছে না। এখন যারা স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব পালন করছেন, তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছেন। স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানেরা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তিন ধাপে উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়। এই নির্বাচনে বেশির ভাগ উপজেলায় বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হন। এই ফলাফলের পর পরবর্তী দুই দফার নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিজয় ঠেকাতে নানা কৌশল গ্রহণ করা হয়। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা জোরজবরদস্তি আর কেন্দ্র দখলের মাধ্যমে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে পৌরসভা নির্বাচনে একইভাবে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হন।
উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে ক্ষমতাসীন দলের জবরদস্তিমূলক নিয়ন্ত্রণের পরও যেসব স্থানে বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন, তারাও স্বাভাবিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। এসব জনপ্রতিনিধি যাতে দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, সেজন্য শপথ গ্রহণের কিছু দিনের মধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে তাদের কাছে পৌঁছে যায় বরখাস্তের নোটিশ। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় সরকার পর্যায়ে তিন শতাধিক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি গত আড়াই বছরে বরখাস্ত হয়েছেন। আরো শতাধিক প্রতিনিধি বরখাস্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন। এসব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে রয়েছে শত শত মামলা। এদের বেশির ভাগই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত।
বরখাস্ত ও মামলার হাত থেকে রেহাই পাননি দেশের চার সিটি করপোরেশনের মেয়রও। বর্তমান সরকারের সময় অনুষ্ঠিত রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়ররা নির্বাচিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে চারজন ইতোমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুজ্জামান সম্প্রতি উচ্চ আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক আব্দুল মান্নানকে রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে বরখাস্ত হওয়ার পর শুধু কারাগারেই যেতে হয়নি, তিনি নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত হওয়ায় গত বছরের ৭ জানুয়ারি সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন নাশকতা মামলায় আসামি করা হয় রাজশাহী সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে। দীর্ঘ দিন তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। এরপর ৭ মে তাকে বরখাস্ত করা হয়। সিটি করপোরশেনের মেয়র ছাড়াও ৪৪ জন কাউন্সিলরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। রাজধানীর বাইরে এই সিটি করপোরেশনগুলোতে জনপ্রতিনিধি না থাকায় উন্নয়ন ও সেবামূলক কার্যক্রম এক রকম স্থবির হয়ে পড়েছে।
সাধারণ মানুষের ভোটে এই জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আইনের বলে তারা বরখাস্ত বা অপসারিত হচ্ছেন। জনগণের প্রতিনিধি হয়েও তারা দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। এদের বরখাস্ত করার সাথে সাথে সিটি করপোরেশনগুলো অনেকটা ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক আইনের বলে জনগণের ভোট মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করতে গিয়ে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার স্বাভাবিক কার্যক্রম ধ্বংস করে ফেলছে।
সিটি করপোরেশনের মেয়রের পর অনেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২১ জন পৌরমেয়র, ৪৪ জন পৌর কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান ৪৭ জন, ভাইস চেয়ারম্যান ৫৮ জন, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ৮৬ ও মেম্বার ৫৪ জনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। (যুগান্তর, ১২ নভেম্বর ২০১৬)। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে গড়ে তিনটির বেশি মামলা রয়েছে। এসব মামলার চার্জশিট দেয়ার পর তাদের বরখাস্ত করা হচ্ছে। এতে সমস্যা দেখা যাচ্ছে, মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন ক্ষমতাসীন দলের কোনো কাউন্সিলর আবার উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন কোনো ভাইস চেয়ারম্যান বা নারী ভাইস চেয়ারম্যান। ফলে সিটি করপোরেশন ও উপজেলা পরিষদগুলোতে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি সাধারণ মানুষও স্থানীয় সরকারের এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীন দলের বাইরে আর কেউ স্থানীয় পরিষদে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। বিরোধী দল সমর্থিত জনপ্রতিনিধিদের বড় একটি অংশকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের সময় বিভিন্ন ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বরখাস্ত করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পদ দখলের উদ্দেশ্যে মামলা ও হয়রানি করা হয়। শত শত জনপ্রতিনিধিকে দায়িত্ব পালনে যেভাবে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে, এ নিয়ে সরকারের বক্তব্য হচ্ছে- আইন তো নিজস্ব গতিতে চলছে। আইন অনুযায়ী তারা দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না, এ ক্ষেত্রে সরকারের কিছুই করার নেই। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘সরকার কোনো জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। যদি কোনো জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে নাশকতা কিংবা যেকোনো মামলায় চার্জশিট দাখিল এবং তা আদালতে গৃহীত হয়, তখন সেই জনপ্রতিনিধিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সাময়িক বরখাস্ত করে। জনপ্রতিনিধি হয়ে অগ্নিসংযোগ ও মানুষ পুড়িয়ে মারলে তারা তো আইন অনুযায়ী বরখাস্ত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।’ আইনের দৃষ্টিতে মন্ত্রী হয়তো সঠিক বলেছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত এমন কোনো নেতা নেই, যাদের বিরুদ্ধে কথিত নাশকতার মামলা দেয়া হয়নি। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এই পরিস্থিতির ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটা তো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। একই সাথে জনগণের ম্যান্ডেট ভুল প্রমাণিত করা হচ্ছে। এটা গণতান্ত্রিক চেতনার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্রের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। সরকারের সদিচ্ছাই পারে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে। সরকার এগুলো থেকে বিরত না হলে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে এবং এর পরিণতি ভালো হবে না। (যুগান্তর, ১২ নভেম্বর ২০১৬)।
বাস্তবতা হচ্ছে, আইনের সুযোগ নিয়ে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করতে কাজ করছে স্থানীয় সরকারের এ আইনটি। বিরোধী দল থেকে যারা নির্বাচিত হবেন, সবাইকে এসব মামলায় বরখাস্ত করা সম্ভব হচ্ছে। স্থানীয় সরকারের এসব নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েও তারা দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। কার্যত এসব রাজনৈতিক মামলার কারণে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার প্রক্রিয়া হুমকির মুখে পড়েছে। আগামী দিনে যে দলই সরকারে আসুক না কেন, একইভাবে বিরোধী দল থেকে নির্বাচিতদের এভাবে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে পারবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রধান লক্ষ্য ছিল ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে জবাবাদিহি করবেন। স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের দাবিও ছিল এ কারণে। সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়ন করবেন আর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকবেন নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা। ক্ষমতাসীন দল ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান পর্যন্ত সব নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করছে। কার্যত একদলীয় শাসন কায়েমের কাঠামোতে পরিণত হয়েছে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা।
এর সর্বশেষ উদহারণ হচ্ছে জেলা পরিষদ নির্বাচন। আগামী ২৮ ডিসেম্বর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে বিরোধী দল বিএনপি বা জামায়াত দূরে থাক, মহাজোটের অংশীদার কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী থাকছেন না। এমনকি জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও প্রার্থী দেবে না। জেলা পরিষদ নির্বাচনের আইন অনুযায়ী, প্রতিটি জেলায় স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিদের ভোটে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা নির্বাচিত হবেন। প্রতিটি জেলায় ১৫ জন সাধারণ ও পাঁচজন সংরক্ষিত মহিলা সদস্য থাকবেন। জেলা পরিষদের এই নির্বাচনের মাধ্যমে আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্র্যসি ফিরে আনা হয়েছে। আর নির্বাচনের ফল কী হবে তা আগেই সবাই বুঝতে পেরেছেন। কারণ সারা দেশে স্থানীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ আগেই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে। নির্বাচনে প্রার্থী দিলেও কোনো লাভ হতো না।
এভাবে সারা দেশে স্থানীয় সরকার থেকে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের সব সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে দেশে কার্যত একদলীয় রাজনৈতিক কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে ক্ষমতাসীন দল দক্ষতার সাথে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের স্থানগুলোতে যাতে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কোনো প্রতিনিধিত্ব না থাকে, নানা কৌশলে তা নিশ্চিত করতে সফল হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীত ফল হচ্ছে যারা জবরদস্তির মাধ্যমে এসব পদ দখল করে আছেন, তাদের সাথে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক থাকছে না। এসব কথিত জনপ্রতিনিধির কর্মকাণ্ডের কোনো জবাবদিহিতা থাকছে না। তারা যা ইচ্ছে এবং যেভাবে ইচ্ছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে অর্থ খরচ করছেন। এর ফলে সর্বস্তরে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি পদ-পদবি ও আর্থিক লেনদেন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বিরোধ বাড়ছে। যেহেতু এসব পদের জন্য জনগণের সমর্থন প্রয়োজন হচ্ছে না, ফলে লাভজনক পদ দখলের জন্য ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে লড়াই বাড়ছে। সামগ্রিকভাবে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দিক থেকে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
alfazanambd@yahoo.com