ক্রাইমবার্তা আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং রাখাইন বৌদ্ধদের সম্মিলিত হামলায় যখন সুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে পাশে দাঁড়িয়েছে বৃহৎ শক্তিশালী দেশ গণচীন।
প্রতিনিয়ত যখন হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে গুলি করে অসহায় নিরস্ত্র মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে, যখন রোহিঙ্গা নারীদের ঘর থেকে বের করে পাইকারী হারে ধর্ষণ করা হচ্ছে, যখন তাদের এই মহাবিপদে কেউ পাশে দাঁড়াচ্ছে না, তখন একটি বৃহৎ শক্তি মৌখিকভাবে হলেও রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক শক্তি প্রয়োগ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।
চীন আনুষ্ঠানিকভাবে ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং আরো রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছে।
সফররত মায়ানমারের একটি প্রতিনিধিদলকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং রি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান সামরিক শক্তি দিয়ে নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে হওয়া উচিত। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে মায়ানমার সীমান্ত যেন অস্থির হয়ে না ওঠে সেজন্য মায়ানমারের সাথে চীন কাজ করবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
রাখাইন এবং মায়ানমার সেনাবাহিনীর যৌথ আক্রমণে রোহিঙ্গা মুসলমানরা যখন জীবন নিয়ে বাংলাদেশ অভিমুখে ছুটছে তখন গণচীনের এই আহ্বান কিছুটা হলেও রোহিঙ্গাদের স্বস্তি দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইতোমধ্যে আমেরিকা এবং পশ্চিমা দুনিয়া স্বীকার করেছে যে, বর্তমানে পৃথিবীতে রোহিঙ্গারা সবচেয়ে নিপীড়িত জাতি। বিশ্ববিখ্যাত মানবাধিকার সংস্থাগুলো স্বীকার করেছে, তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য উপগ্রহ থেকে ছবি তুলেছে। ঐসব ছবি থেকে দেখা যায় যে, বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বর্মী সেনারা রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।
ঐসব ছবি থেকে আরো দেখা যায়, রোহিঙ্গারা তাদের বাপ-দাদার ভিটা মাটি ছেড়ে পালাচ্ছে। হাই ডেফিনেশন ছবি থেকে দেখা যায়, হাজার হাজার রোহিঙ্গা পদব্রজে এবং নাফ নদীতে নৌকাযোগে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। এখন তারা এতোদূর বলছে যে, রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনী যে জুলুম করছে সেটি মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
মায়ানমারে নিরস্ত্র জনতাকে একটি সামরিক চক্র বছরের পর বছর ধরে নিধন করে যাচ্ছে, মানবতার এতো বড় অপমানেও এবং মানবাধিকার এমন ভয়াবহ রূপে লঙ্ঘিত হলেও রাশিয়ার কোনো বিকার নাই। ভারত নিজ দেশে এবং বিদেশে মানবাধিকারের বড় ফেরিওয়ালা। বাংলাদেশে সম্প্রদায় বিশেষের সামান্য ক্ষতি হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা সে ব্যাপারে নাক গলায়। এই তো কয়েক বছর আগেও ভারত বাংলাদেশের পার্বত্য সমস্যায় নাক গলিয়েছিলো। অজুহাত ছিলো, তার সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে তার নাকি নিরাপত্তা বিঘিœত হয়। মায়ানমারও ভারতের প্রতিবেশী। অথচ সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঘরছাড়া করা হচ্ছে। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মায়ানমারের সামরিক জান্তা ২৫ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানের মধ্যে ১২ লক্ষকেই ঘরছাড়া করেছে। এসব উদ্বাস্তুদের মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ৫ লাখ, পাকিস্তানে ২ লাখ, সৌদি আরবে ৪ লাখ এবং থাইল্যান্ডে ১ লাখ।
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট মোতাবেক গত অক্টোবর মাস থেকে আরাকানে যে জাতিগত নিধন চলছে তার ফলে মাত্র ২ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১ লক্ষ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান বাস্তুহারা হয়েছে।
জাতিসংঘ বলেছে, তাদের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে চোরা পথে বাংলাদেশে ঢুকছে। জাতিসংঘই বলেছে, সঠিকভাবে গণনা করলে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। বলা হয় যে, মায়ানমার সরকারের সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযানের ফলে ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ ছিন্নমূল হয়েছে। এদের প্রায় সকলেই বাংলাদেশে আশ্রয় লাভের জন্য সুযোগ খুঁজছে।
জাতিসংঘ তাগিদ দিয়েছে, এসব ছিন্নমূল নির্যাতিত মানুষের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়া উচিত যাতে করে তারা তাদের চরম দুর্দিনে প্রাণে বেঁচে থাকার একটি অবলম্বন পায়। তাদের এই উদ্বেগ প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তারা সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসছে না। অথবা এই জাতিগত নিধন ও গণহত্যা বন্ধের জন্য মায়ানমারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করছে না।
এমন একটি পরিস্থিতিতে মায়ানমারের প্রকৃত ক্ষমতার আধার অং সান সূচি সিঙ্গাপুরে বলেছেন যে, তিনি মায়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একটি সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু কোন কোন জাতিগোষ্ঠী সেটি তিনি মোটেই পরিষ্কার করে বলেননি।
মায়ানমারের রয়েছে ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী। রোহিঙ্গারা তাদের অন্যতম। বার্মার মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ হলো রোহিঙ্গা মুসলমান। এই ২৫ লাখ মুসলমানের সমস্যা এবং তাদের গণহত্যা সম্পর্কে সূচি এখনো সম্পূর্ণ উদাসীন।