মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের অস্ত্র ধর্ষণ!

ক্রাইমবার্তা আন্তর্জাতিক ডেস্ক : নিকট অতীত বিবেচনা করা হলেও অন্তত গত ৭ দশক ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে নিজদেশের বিভিন্ন সংখ্যালঘু নারীদের ওপর। উইকিপিডিয়ায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পরিচিতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন করার Rape Mapব্যাপারে নির্যাতন, ধর্ষণ, শিশু সৈনিক ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অব ফ্রি ট্রেড ইউনিয়নের এক রিপোর্টে শত শত নারী, পুরুষ ও শিশুদের জোরপূর্বক বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োগের জন্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করা হয়েছে। এধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন দীর্ঘদিন ধরে আহবান জানিয়ে আসছে। তবে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু নারীদের ধর্ষণের বিষয়টি সারাবিশ্বে ধিকৃত হলেও তাতে কোনো কান দেয়নি দেশটির সেনাবাহিনী।rsz_146014611_1-550x310

২০০২ সালে দি শান হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন তাদের এক রিপোর্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে ১৭৩টি নির্যাতনের ঘটনায় ৬২৫ জন নারী ও শিশুকে ধর্ষণের তথ্য তুলে ধরে। প্রতিবেদনে বলা হয় এ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে নারী ধর্ষণের ঘটনা বাস্তবে আরো অনেক বেশি। কারণ হিসেবে বলা হয় দেশটির সেনাবাহিনী পরিকল্পিত ও অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় এধরনের নারী নির্যাতন করে থাকে। বরং ধর্ষণ হচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে এক মোক্ষম অস্ত্র। তবে মিয়ানমার অন্য কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত নয় অথচ নিজ দেশের সংখ্যালঘু নারীদের ওপর ধর্ষক হিসেবে সেনাবাহিনীর এধরনের ভূমিকা দশকের পর দশক চললেও এর বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কোনো ব্যবস্থা নিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনায় অন্তত ২৫ ভাগ নারী মারা যায়। ৬১ ভাগ ক্ষেত্রে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা।

রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালের ২০০৩ সালের ‘ নো সেফ প্লেস: বার্মাস আর্মি এন্ড দি রেপ অফ এথনিক ওমেন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীদের সেনা ক্যাম্পে আটক রেখে মাসের পর মাস পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়। রোহিঙ্গা মুসলিম নারী ছাড়াও আরো বেশ কিছু জাতিগত সংখ্যালঘু নারীদের ওপর চলে এধরনের ধর্ষণ। এধরনের ধর্ষণ বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন দেশের কাছে সুনির্দিষ্ট বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরে কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।

এরপর মিয়ামারের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। অংসাং সুচি ক্ষমতায় আসার পর এক বছর গত হলেও মিয়ানমারের নারী ধর্ষণে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফলে বিগত দিনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের প্রমাণপত্রসহ যেসব সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা সেদিকেও ভ্রুক্ষেপ করেনি দেশটি। গত বছর দি ওমেন লিগ অব বার্মা এক প্রতিবেদনে বলে নির্বাচন ও বেসামরিক সরকার গঠন হবার পরও কিভাবে সেনাবাহিনী ধর্ষণকে এখনো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে তা বোধগম্য নয়। ২০১০ সালে শতাধিক নারীকে ধর্ষণ করেছে মিয়ামারের সেনাবাহিনী। এদের অর্ধেককে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয় যাদের মধ্যে ২৮ জন নারী অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণে মারা যায়।

মিয়ানমারের যেসব স্থানে জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিয়ন্ত্রণে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী, সেসব স্থানে সেনাসদস্যদের হাতে ধর্ষণ অতি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওমেন লিগ অব বার্মার নেত্রী জুলিয়া মারিপ বলেন, ধর্ষণের জন্যে সেনাবাহিনী সবসময় দায়মুক্তি পেয়ে আসছে। কাচিন, শান কিংবা রোহিঙ্গা নারী হোক সংখ্যালঘু নারীদের ধর্ষণের জন্যে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীকে কোনো জবাবদিহী করতে হয় না। ২০০২ সালে শান ওম্যানস এ্যাকশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয় ৮৩ ভাগ ধর্ষণের শিকার হয় সংখ্যালঘু নারীরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অফিসারদের হাতে। ধর্ষণই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এক ভীতিপ্রদ রণকৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ধর্ষণ হলেও এ নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করার সাহস রাখেন না। মিয়ানমারের সংবিধান অনুসারে দেশটির সেনাবাহিনীকে আদালতে বিচারের আওতায় আনার কোনো বিধান নেই ও যুদ্ধাপরাধ, ধর্ষণ ও সহিংসতার জন্যে ক্ষমার সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন হলেও মিয়ানমার তাতে কোনো গুরুত্ব দেয় নাmyanmar-army-702x336

এধরনের ধর্ষণের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন সিনেটর পেন্টাগন থেকে কোনো তহবিল মিয়ানমারকে প্রদান বন্ধ করে দেয়ার জন্যে একটি বিল আনেন। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও মিয়ামারের জাতিগত সংখ্যালঘু নারীদের ধর্ষণ বন্ধে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষে নিতে দেখা যায়নি। ২০১৪ সালে হার্ভার্ড ল’ স্কুলের দি ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ক্লিনিকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধান অনুযায়ী মিয়ামারের নির্বাচিত অংসাং সুচি সরকার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের বিচার করার ক্ষমতাই যেন রাখেন না। আইনেই আছে মিয়ানমারের সরকারি কর্মকর্তা বা সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এধরনের নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও তা তাদের অফিশিয়াল পদে বহাল তবিয়তে থেকেই মোকাবেলা করতে পারবেন। তাই মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকার এধরনের নারী ধর্ষক বা নির্যাতনকারী কোনো সামরিক কর্মকর্তাকে বিচারের আওতায় এনেছে এমন কোনো নজির নেই। ভূকৌশলগত কারণে, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ও গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করছে এ আশায় পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ামারের সেনাবাহিনীর সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণের ঘটনায় কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে চায় না। আন্তর্জাতিক মঞ্চে মিয়ানমার এসব কারণে ক্ষমাশীল অনুপ্রেরণা পেয়ে আসছে। উল্টো চীন, ব্রিটেন, নরওয়ে, জাপান, অস্ট্রেলিয়া মিয়ানমারে বিনিয়োগের জন্যে ধারাবাহিকভাবে ওকালতি করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসন বরাবরাই এশিয়ার দিকে নজর রাখতে যেয়ে মিয়ামারের নারী ধর্ষণের বিষয়টি বিবেচনায় আনেনি।

২০১০ সালে মিয়ানমারে অংসাং সুচি বেসামরিক সরকার গঠন করার পর ওমেন লিগ অন্তত ১০৪ জন সংখ্যালঘু নারীকে সেনাবাহিনীর হাতে ধর্ষণের দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয় এখনো মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বাধাহীনভাবে সংখ্যালঘু নারীদের ধর্ষণ করে যাচ্ছে। এধরনের নির্যাতনকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে জাতিগত সংখ্যালঘু নারীদের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। জাতিগত সংখ্যালঘুদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও জাতিগত সম্প্রদায়কে ভেঙ্গে দেয়ার অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণকে ব্যবহার করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ৮ বছরের শিশু তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি এমন নজির রয়েছে অসংখ্য।

ওমেন লিগ তাদের হাতে প্রাপ্ত তথ্যকে টিপস অব দি আইসবার্গ বা খুবই সামান্যতম বলে বিশ্বাস করে একারণে যে ধর্ষণের পর তা নিয়ে কেউ অভিযোগ করার সুযোগ পায় না, ঘটনাস্থলে কোনো মানবাধিকার সংগঠন ও মিডিয়া পর্যন্ত যাওয়ার কোনো সুযোগ পায় ন্।া এধরনের ঘটনায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী শাস্তির বাইরে থাকে বলে বারবার এমন নির্যাতন চালাতে রীতিমত আত্মবিশ্বাসে ভরপুর থাকে এবং প্রকাশ্যে তা ঘটিয়ে থাকে। ওমেন লিগের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে অন্তত ধর্ষণের মত ঘটনাকে রেহাই দিতে সংস্কারের আবেদন জানানো হয়। ২০০৮ সালের সংবিধানে সংশোধন আনার কথাও বলে ওমেন লিগ।myanmars-army

তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার মিয়ানমার সরকারকে দেশটির সেনাবাহিনীর ধর্ষণের মত ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি তদন্তের আহবান জানালে তা নাকচ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যারি হার্ফ বলেন, গত তিন বছরে মিয়ানমার অনেক উন্নয়ন করতে সমর্থ হলেও দেশটির সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির আরো উন্নতি প্রয়োজন।

 

 

 
 

 

Check Also

স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় রিকশা চালালেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার

ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন পাকিস্তানি হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ! ভাবতে অবাক লাগলেও সম্প্রতি তেমনি এক ঘটনা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।