ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রিপোট:আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও দেশে আকস্মিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের সংখ্যা বেশ খানিকটা বেড়েছে। গত ৭ দিনে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় র্যাব-পুলিশের কথিত ক্রসফায়ারে ১২ জন মারা গেছে। এর মধ্যে এক রাতেই ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া চলতি মাসের বিভিন্ন সময় এ ধরনের ঘটনায় আরো পাঁচজন নিহত হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধে এ ধরনের মৃত্যুর মিছিল দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
বিশেষ করে ক্রসফায়ারের ‘নতুন গল্প’ বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তাদের ধারণা, সরকার এক ঢিলে দুই পাখি মারতে এই ভয়ঙ্কর উদ্যোগ নিয়েছে, যদিও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা তা অস্বীকার করেছেন।
প্রসঙ্গত, এতদিন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের পর তা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘ক্রসফায়ার’ বলে দাবি করা হলেও সম্প্রতি র্যাব-পুলিশ এই ছক পাল্টেছে। বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর অধিকাংশ ঘটনাই এখন সন্ত্রাসীদের দু’পক্ষের গোলাগুলির জের বলে দাবি করা হচ্ছে। একই ধারাবাহিকতায় এ ধরনের প্রতিটি ঘটনার পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপারেশনাল টিম কথিত দু’পক্ষের ১০-১২ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করছে।
অভিযোগ রয়েছে, কথিত ক্রসফায়ারের পর থানায় দায়েরকৃত মামলায় যাদের আসামি করা হচ্ছে, তাদের অধিকাংশ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, যাদের কারো এসব ঘটনার সঙ্গে কোনো যোগসূত্র নেই। শুধু তাদের হয়রানি-নির্যাতনের টার্গেট করে খোদ সরকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে এই অপতৎপরতা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
এদিকে, একাধিক মানবাধিকার সংগঠনের মাঠপর্যায়ের নিবিড় অনুসন্ধানে বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের অধিকাংশকে ঘটনার দীর্ঘদিন আগে গ্রেপ্তার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোপন হেফাজতে রাখার তথ্য মিলেছে। নিহতদের অনেক স্বজনও এ ব্যাপারে প্রকাশ্য অভিযোগ তুলেছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ৪২ জন। ২০১৪ সালে ১২৮ জন এবং ২০১৫ সালে ১৪৬ জন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।
অথচ চলতি বছর আরো এক মাস বাকি থাকলেও এরই মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ১৬৮ জনে এসে ঠেকেছে।
এর মধ্যে শুধু গত ২৪ নভেম্বর রাতেই পাবনার ঈশ্বরদী এবং ফরিদপুরের মধুখালীতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ছয়জন নিহত হয়েছে। তাদের সবাই ডাকাত ছিল বলে পুলিশ দাবি করেছে। এর মধ্যে ঈশ্বরদীতে র?্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে চারজন। আর মধুখালীতে গুলিবিদ্ধ দুজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ বলেছে, নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে দুই ডাকাত নিহত হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে নিহত ওহিদুলের বড় ভাই মন্টু জোয়ার্দার বলেন, বৃহস্পতিবার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তাকে গুলি করে হত্যা করে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ গল্প সাজানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে আসকের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, কয়েক বছর ধরে যেভাবে ‘ক্রসফায়ার, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা গুমের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে একটা ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বিচারহীনতার কারণে কখনো গুমের সংখ্যা, কখনোবা ক্রসফায়ারের সংখ্যা বাড়ছে। সাম্প্রতিককালে লক্ষ করা যাচ্ছে, বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও এর শিকার হচ্ছেন।
তিনি বলেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিটি ঘটনারই বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানানো হচ্ছে; কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করছে না। অল্প সময়ে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির জন্য দ-মুক্ততার চর্চা করা হচ্ছে বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
নূর খান লিটন বলেন, জনগণ ভয়ার্ত পরিবেশের কারণে সোচ্চার হতে পারছে না। এসব ঘটনা প্রতিরোধের দায় এবং দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে র্যাবের হাতে ৪৪ জন, পুলিশের হাতে ৯১ জন, ডিবির হাতে ১২ জন, আনসার/রেলপুলিশের হাতে একজন এবং বিজিবি/পুলিশের হাতে তিনজনসহ মোট ১৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার-পূর্ববর্তী ক্রসফায়ারে ১০০ জন, হেফাজতে থাকাকালে বন্দুকযুদ্ধে ২৭ জন, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে ৫ জন এবং গ্রেপ্তার-পূর্ববর্তী গুলিতে ৯ জন মারা গেছে। পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে ৪ জন এবং গ্রেপ্তারের পর রহস্যজনকভাবে দুইজনের মৃত্যু হয়।
সর্বশেষ গত বুধবার রাতে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলায় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ ডাকাত সর্দার দুলালবাহিনীর প্রধান দুলাল হোসেন নিহত হন। র্যাব জানায়, দুলালের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ ও ডাকাতির অভিযোগসহ বিভিন্ন থানায় ১০টির বেশি মামলা রয়েছে।
একই রাতে বেনাপোলে বন্দুকযুদ্ধে আনসার সদস্য ফিরোজ হত্যা মামলার প্রধান আসামি রিপন (৩২) নিহত হয়েছে। পুলিশের দাবি, বুধবার দিবাগত গভীর রাতে যশোর-মাগুরা সড়কের সদর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া এলাকায় সন্ত্রাসী দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে রিপন মারা গেছে। তবে নিহতের একাধিক ঘনিষ্ঠজনের দাবি, রিপনকে পুলিশ আগেই গ্রেপ্তার করেছিল। তাদের গুলিতেই তার মৃত্যু হয়েছে।
যদিও বেনাপোল পোর্ট থানার উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মতিউর রহমান জানান, বেনাপোল বন্দরের আনসার সদস্য ফিরোজকে হত্যার পর থেকে রিপন পালাতক ছিল। তার বিরুদ্ধে বেনাপোল থানায় অস্ত্র, নারী-শিশু পাচার এবং ছিনতাইসহ ১৪টি মামলা রয়েছে।
যশোর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইলিয়াছ হোসেন জানান, সদর থানার পাঁচবাড়িয়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই দল সন্ত্রাসীর মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে সন্ত্রাসীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে সেখানে পড়ে থাক?া গুলিবিদ্ধ রিপনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে আনার পথে তার মৃত্যু হয়। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে একটি ওয়ান শূটারগান, একটি গুলি এবং একটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।
এর মাত্র এক দিন আগে (২৯ নভেম্বর) রাজধানীর রামপুরা বালুর মাঠে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পবিত্র সমাদ্দার ও আলী স্বপন নামে দুই যুবক নিহত হয়। র্যাবের দাবি, তারা পেশাদার ছিনতাইকারী, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী এবং একাধিক মামলার আসামি ছিল। ঘটনাস্থল থেকে দুটি অস্ত্র এবং কয়েক রাউন্ড গুলি উদ্ধারের কথা দাবি করেন র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার গোলাম সারোয়ার। ওই অভিযানকালে চারজন র্যাব সদস্যও আহত হয়েছেন বলে জানান তিনি।
এর আগে ২৩ নভেম্বর বরগুনার আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী গ্রামে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আবদুল জব্বার নামে একজন নিহত হন। পুলিশের ভাষ্য, আবদুল জব্বার ডাকাত সর্দার। তার সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের পর ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশি পিস্তল এবং দুটি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আমতলী, বরগুনা সদর ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন থানায় হত্যা এবং ধর্ষণসহ ১৫টি মামলা রয়েছে।