রাজধানীর ওয়ারীর স্বামীবাগ এলাকার নির্মাণাধীন বাসায় গত বছরের ২৭ অক্টোবর রাতে রিয়াদকে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এর পর ঘটনাটি ভিন্ন খাতে নিতে ছিনতাইকারীর গুলিতে নিহত হওয়ার গল্প ফাঁদেন হোটেল মালিক সোহেল। এ ঘটনায় নিহতের ভাই রিপন হোসেন বাদী হয়ে সোহেল, কর্মচারী জসীম ও খবিরের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।
ওয়ারী থানার ওসির দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সেলিম মিয়া বলেন, তদন্ত শেষে গত ২৭ জুলাই এ মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। তাতে হোটেল মালিক সোহেল, কর্মচারী খবির হোসেন ওরফে খবির মেসিয়ার ও জসীম উদ্দিন চৌকিদারকে হত্যায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। তখন পর্যন্ত সোহেল ও খবিরকে গ্রেফতার করা যায়নি। এরপর মামলাটির বিষয়ে আর কিছু পুলিশের জানা নেই। পলাতক আসামিরা আদালতে আত্মসমর্পণ করে থাকলে সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে বলতে পারবেন।
ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ প্রথম আদালত সূত্রে জানা যায়, ১৩ মাস ধরে পলাতক সোহেল ও খবির আত্মসমর্পণ করে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করেন। এ সময় অতিরিক্ত সরকারি কেঁৗসুলি তাদের জামিনের বিরোধিতা করে মামলার প্রেক্ষাপট ও হত্যায় তাদের ভূমিকা তুলে ধরেন।
উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত বলেন, “তারা দু’জনই মামলার এজাহারনামীয় আসামি এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সুস্পষ্ট ও গুরুতর। এ অবস্থায় সার্বিক বিবেচনায় তাদের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করা হলো। তাদের জেলহাজতে পাঠানো হোক।’
অতিরিক্ত সরকারি কেঁৗসুলি আবদুস সাত্তার দুলাল সমকালকে বলেন, আসামিরা হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই পলাতক ছিলেন। পুলিশের তদন্তে তাদের অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে জামিন আবেদনের বিরোধিতা করা হয়।
এদিকে আত্মসমর্পণের আগে জামিন পেতে ও অভিযোগমুক্ত হতে বহুমুখী তৎপরতা চালান প্রভাবশালী সোহেল। তার হয়ে স্বজনরা বাদীপক্ষকে হুমকি দিয়ে ও টাকার বিনিময়ে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন। এর একপর্যায়ে নিহত রিয়াদের পরিবারকে ৪০ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেন সোহেলের এক খালু (নাম জানা যায়নি)। প্রথমে ৩০ লাখ টাকা এবং হোটেল চালু হওয়ার পর আরও ১০ লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। তবে তার আগেই মামলা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। রিয়াদের হতদরিদ্র পরিবার বাধ্য হয়ে এতে রাজি হয়।
নিহত রিয়াদের ভাই রিপন হোসেন সমকালকে বলেন, ভাইকে তো আর কোনোভাবেই ফিরে পাব না। সোহেলের স্বজনের চাপও তারা সহ্য করতে পারছিলেন না। এ কারণে শেষ পর্যন্ত তারা টাকা নিতে রাজি হন। সোহেলের খালুর পরামর্শ অনুযায়ী গত আগস্টে তিনি (রিপন) ও তার মা রোকেয়া বেগম গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর থেকে বাসে ঢাকার সায়েদাবাদে এসে নামেন। খালু তাদের রিকশায় করে সোহেলের এক বন্ধুর বাসায় নিয়ে যান। সেখানে তাদের দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়। বাকি টাকা পরে দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়। তখন টাকা নিয়ে গ্রামে ফিরে যান মা-ছেলে; কিন্তু এর পর থেকে ওই খালু আর যোগাযোগ করেননি। তার নম্বরও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
অপর একটি সূত্র জানায়, সোহেল ও তার স্বজনরা সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার (আইন পেশায় সম্পৃক্ত) কার্যালয়ে যান। সেখানে তারা বলেন, যত টাকা লাগে তারা দিতে প্রস্তুত, শুধু সোহেলের জামিন পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আইনজীবী নেতা তাদের আশ্বস্ত করেন। তার পরামর্শে সোহেল ও তার কর্মচারী খবির গোপনে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
নিহত রিয়াদের দূর সম্পর্কের চাচা নাজমুল হায়দার সুমন বলেন, পুলিশ এতদিন বলেছিল, সোহেল ভারতে পালিয়ে গেছেন। কিন্তু শুরু থেকেই স্বজনের সন্দেহ ছিল, পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে তিনি দেশেই আছেন। এখন বিষয়টি স্পষ্ট হলো।
তদন্ত সূত্র জানায়, রিয়াদ হত্যা মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট, চিকিৎসক, পুলিশসহ ৪১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। হত্যার ঘটনা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন ১৫ জন। তাই সোহেলসহ অন্য আসামিদের অপরাধ প্রমাণে সমস্যা হবে না। সমকাল