তিন বছরেও সন্ধান মেলেনি এক রাতে নিখোঁজ ৮ জনের

ক্রাইমবার্তা রিপোট:মাঝে মাঝেই র‌্যাব অফিসের সামনে গিয়ে বসে থাকেন হাজেরা খাতুন। তিন বছর ধরে তিনি ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশায় অসুস্থ শরীর নিয়ে এখানে-সেখানে ছুটে চলেছেন। ছেলের চিন্তায় ডায়াবেটিস, প্রেসার, হার্টের রোগসহ নানা অসুখ বাঁধিয়েছেন। এখন ঘর থেকে বের হতেও যেন আর শক্তি পাচ্ছেন না। ছেলে গুম হওয়ার পর কেটে গেছে একে একে ১০৯৫ দিন। প্রতিটি দিন তার কাছে পাথরসম। মন মানে না। কবে ছেলের সন্ধান পাবেন, সেই আশায় এখনও এই মা পথচেয়ে আছেন। তার ধারণা, ছেলেকে যারা ধরে নিয়ে গেছে, মন নরম হলে তারা একদিন তাকে ফেরত দেবে।

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে হাজেরা খাতুনের ছেলে সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ ৬ জনকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়। একই দিন রাজধানীর শাহীনবাগের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় আরও ২ জনকে। এ আট জনের স্বজন ও বাবা-মা প্রতীক্ষায় আছেন, তাদের সন্তান কবে ফিরে আসবে।

পরিবারের অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই-ব্লক থেকে অবিভক্ত সিটি কর্পোরেশনের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম ওরফে সুমন (৩৪), তার খালাতো ভাই জাহিদুল করিম ওরফে তানভীরসহ (৩০) পূর্ব নাখালপাড়ার আবদুল কাদের ভূঁইয়া ওরফে মাসুম (২৪), পশ্চিম নাখালপাড়ার মাজহারুল ইসলাম ওরফে রাসেল (২৪), মুগদার আসাদুজ্জামান ওরফে রানা (২৭) ও উত্তর বাড্ডার বেরাইদ এলাকার আল আমিনকে (২৬) র‌্যাব পরিচয় তুলে নেয়া হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর রাত ২টার দিকে শাহীনবাগের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এএম আদনান চৌধুরী (২৮) ও গাড়িচালক কাওসার (২৫) নামে আরও দু’জনকে। কিন্তু র‌্যাব বা পুলিশ তাদের আটকের বিষয়টি বরাবরই অস্বীকার করছে।

গুম হওয়া ৮ জনের সন্ধান পাওয়ার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে দফায় দফায় দেখা করেছেন তাদের স্বজনরা। তার সহযোগিতাও চেয়েছেন। একই রাতে ৮ জন গুম হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘কারা কখন গুম হয়েছে, আমার জানা নেই। এখন তো অনেকে সন্ত্রাসী বাহিনী বা জঙ্গি বাহিনীতে যাচ্ছে। এরাও হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে নিখোঁজ হয়েছে। নিখোঁজদের অনেকেই ফেরত এসেছে, এরাও হয়তো আসবে।’

শাহীনবাগের বাসায় সুমনের বোন আফরোজা বেগম প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে যুগান্তরকে বলেন, সাজেদুলসহ ৬ জনকে ‘র‌্যাব-১’ লেখা গাড়ি থেকে নেমে র‌্যাবের পোশাক পরা অস্ত্রধারী কয়েকজন তুলে নেয়। সেই দিন থেকে তিন বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আজও তাদের খোঁজ মেলেনি। আমরা অপেক্ষায় আছি কখন আমাদের ভাই ফিরবে। আমার ছোট বোন সাজেদা আক্তার দুই দফায় জাতিসংঘের কাছে গিয়েও আমার ভাইকে ফেরত পাওয়ার জন্য আবেদন করেছে। কিন্তু সাজেদুলের কোনো খোঁজ মেলেনি।’ সাজেদুলের স্ত্রী নাছিমা আক্তার বলেন, ‘কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। এখন আর কাঁদতেও পারি না। প্রতিদিনই ভাবি, ঘুম ভেঙেই হয়তো আমার সন্তান রাইতা ও আরওয়ার বাবার খবর পাব। কিন্তু সেই অপেক্ষায় দিন আর শেষ হয় না।’ সাজেদুলের মেয়েরা জানে বাবা কাজের জন্য বাইরে গেছেন। তাদেরও প্রতিদিন প্রশ্ন, কখন ফিরবে তাদের বাবা। কিন্তু সেই খোঁজ আর মিলছে না।

একই সঙ্গে তুলে নেয়া হয় সাজেদুলের খালাতো ভাই তানভীরকে। তানভীরের খালাতো বোন সাজেদ আক্তার জানান, ‘ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তার (তানভীর) মা কারও সঙ্গে কথা বলেন না। এমনকি বোনের সঙ্গেও না। তিনি একরকম মৃত্যু পথযাত্রী।’

পশ্চিম নাখালপাড়া থেকে নিখোঁজ মাজহারুল ইসলাম ওরফে রাসেলের বাবা আমিনুল হক যুগান্তরকে বলেন, আমার ছেলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষে বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পাস করে। এরপর লিখিত পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ৪ ডিসেম্বর তাকে তুলে নেয়ার পর র‌্যাব-১, র‌্যাব হেডকোয়ার্টার, পুলিশ সদর দফতর, ডিবি ও থানা পুলিশের কাছে অসংখ্যবার গিয়েছি। কিন্তু তারা শুধু বলে, আমরা আনিনি। খোঁজ নিচ্ছি। কিন্তু খোঁজ পাচ্ছি না। ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম আরও জানান, তার গ্রামের বাড়ি শেরপুরের নকলা উপজেলার বকুতিয়া গ্রামে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার জন্য তিনি পশ্চিম নাখালপাড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন।

নিখোঁজ আল আমিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষে এলএলবি পড়ত। তিনি ছাত্রদল করলেও কোনো পদে ছিলেন না। তার ভাই রুহুল আমিন জানান, আল আমিনের শোকে বাবা আহমাদুল্লাহ ও মা জেসমিন বেগম সারা দিন কাঁদেন। তারা তিন বছর ধরে তার কোনো খোঁজ না পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আল আমিনের মা-বাবা এখন ভাটারা থানার উত্তর বেরাইদ এলাকায় থাকেন। সেখানে তার মা জানান, তার ছেলে খুব মেধাবী ছিলেন। এখন চাকরি করতেন, সংসারের হাল ধরতেন। কিন্তু সেই ছেলে কোথায় আছে, কেমন আছে, কিছুই জানতে পারছেন না।

এএম আদনান চৌধুরীর বাবা রুহুল আমিন মাস্টার যুগান্তরকে বলেন, তিন বছরেও আমার আদনানের কোনো খবর পেলাম না। আমাদের সন্তানরা গুম হয়ে গেল, কিন্তু সরকার আজ পর্যন্ত কিছু জানাতে পারল না। আমরা র‌্যাব, পুলিশ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর সব জায়গায় গিয়েছি। সবার একটাই কথা- ‘আমরা জানি না, আমরা আটক করেনি।’ ঘটনার দিনের বিবরণ তুলে ধরে রুহুল আমিন জানান, ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাত ২টার দিকে শাহীনবাগের বাসার মূল ফটকে কয়েকজন এসে কড়া নাড়লে তিনি দরজা খুলে দেন । দেখেন বাসার সামনে ১৪-১৫ জন কালো পোশাকধারী লোক। তারা একটি সাদা ও একটি ছাই রঙের মাইক্রোবাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র। তারা প্রশাসনের লোক পরিচয় দিয়ে বাসায় প্রবেশ করে। পুরো বাসায় তল্লাশি শেষে আদনানকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে চলে যায়। সেই থেকে আদনানের আর খবর নেই।

নিখোঁজ রানা, মাসুম ও কাওসারের স্বজনরা জানান, তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর কোনো থানায় মামলা বা জিডি ছিল না। বিনা কারণেই তাদের তুলে নিয়ে গুম করা হয়েছে। যদি তাদের কোনো অপরাধ থাকে, তাহলে গ্রেফতার করে আইনের হাতে সোপর্দ করা যেত। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কোনো হদিস মেলেনি।

নিখোঁজ ৮ জনের বিষয়ে র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মাসুদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘ভিক্টিম পরিবারগুলো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। আমরা নিখোঁজদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। কিন্তু তাদের কোনো খোঁজ পাইনি।’

একই মাসে আরও ১১ গুম : ২০১৩ সালে ২৮ নভেম্বর খালিদ হাসান ওরফে সোহেল ও সম্রাট মোল্লা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক থেকে; ২ ডিসেম্বর জহিরুল ইসলাম ওরফে হাবিবুল বাশার জহির, পারভেজ হোসেন, মো. সোহেল ও মো. হোসেন চঞ্চলকে শাহবাগ থেকে; ৬ ডিসেম্বর নিজাম উদ্দিন ওরফে মুন্না ও তরিকুল ইসলাম ওরফে ঝন্টু দক্ষিণখানের মোল্লারটেক থেকে; ৭ ডিসেম্বর মাহবুব হাসান ও কাজী ফরহাদ সবুজবাগ থেকে এবং ১১ ডিসেম্বর মিরপুরের পল্লবী থেকে সেলিম রেজা ওরফে পিন্টু গুম হন। তাদের পরিবারও আজ পর্যন্ত তাদের হদিস পায়নি।

Check Also

সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে দুবলার চরে গেলেন ৪০১জন পূণ্যার্থী

উপকূলীয় অঞ্চল (শ্যামনগর): পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে অনুমতি নিয়ে বঙ্গোপসাগরের দুবলার চরে রাস মেলায় গেছেন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।