ক্রাইমবার্তা রিপোট:: ভারতের তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম জয়ললিতা। ৬৮ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গতকাল রাতে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
জয়রাম জয়ললিতা অনন্য প্রতিভা দ্বারা ‘কাভারচি কান্নি’ খেতাভ লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে ‘পুরাতছি থালাইভি আম্মা’ যার অর্থ ‘প্রতিবাদী নেত্রী’র উপাধি লাভ করেন।রাজনীতিতে প্রবেশের পূর্বে চলচ্চিত্র জগতে কাজ করেছেন জয়ললিতা। ১২০টিরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। তামিল, তেলেগু, হিন্দি, কন্নড় এমনকি ইংরেজি সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন জয়ললিতা। তার সময়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী ছিলেন তিনি।রুপালি জগতে পা রাখার কোনো ইচ্ছা ছিল না জয়ললিতার। আইনজীবী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যে ছিল অন্যকিছু। মায়ের ইচ্ছাতে আস্তে আস্তে তিনি তামিল সিনেমা জগতে পরিচিত হতে থাকেন। তবে তার আগে তিনি নাচ এবং মঞ্চ নাটকে ছোট ছোট খণ্ড চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কাকতালীয়ভাবে তিনি কন্নড় সুপারস্টার রাজকুমার এর শ্রী শাইলা মাহাথমে সিনেমাতে শিশুশিল্পী হিসেবে একটি গানে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান।এর কয়েক বছর পরে ১৯৬১ সালে তিনি এপিস্টেল সিনেমাতে প্রধান নারী চরিত্রে কাজ করার সুযোগ পান। এটা তার জীবনে একমাত্র ইংরেজি সিনেমা। এই সিনেমার অর্থায়ন করেছিলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরির ছেলে শঙ্কর গিরি। সিনেমাটি কয়েক বছর পরে ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায়। এমনকি প্রেক্ষাগৃহেও তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি।মাত্র ১৫ বছর বয়সে একটি ব্লকবাস্টার হিট কন্নড় সিনেমায় অভিষেক ঘটে জয়ললিতার। সিনেমাটির নাম চিন্নাদা গোম্বে। সিনেমাটি প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছিলেন বি.আর. পান্থুলু। সিনেমায় সাফল্য দেখে তার মা, ভেদাভাল্লি যিনি নিজেও অভিনেত্রী ছিলেন। তিনি ‘সন্ধ্যা’ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি মেয়েকে অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ দেন। যাতে তিনি পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে পারেন।জয়ললিতা ১৯৪৮ সালে কর্নাটকের মান্দ্যা জেলায় একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্কুল জীবন শুরু হয়েছিল ব্যাঙ্গালুরুতে। এরপরে তিনি তার মার সাথে চেন্নাইয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। ওই সময় তার বয়স ছিল ১০।
তিনি ছিলেন মূলত তামিল সিনেমার অভিনেত্রী। কিন্তু তার জন্ম কর্নাটকে হওয়ায় এ নিয়ে বেশ বড় ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে। জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। ‘কন্নড়িগা গার্ল’ নামক কন্নড় অঞ্চলের এক বিশেষ পোশাক পরতে না চাওয়ায় একটি সংগঠনের তোপের মুখেও পড়তে হয়েছিল তাকে।এই ঝামেলা আরো উস্কে দিয়েছিলেন তিনি যখন একটি তামিল ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমি কানাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছি। কন্নড় ভাষায় অবলীলায় কথা বলতে পারি। কিন্তু আমি তামিলে বড় হয়েছেন। আমি সেখানকারই মানুষ।’তার এই মন্তব্য কন্নড় সংগঠনগুলো মোটেও ভালোভাবে নেয়নি। পরবর্তীতে তিনি যখন কানাড়ার প্রিমিয়ার স্টুডিও মাইসুরুতে একটা কন্নড় সিনেমার রিমেক গঙ্গা গৌরি’র শুটিং করতে গিয়েছিলেন সেখানে তাকে একটি সংগঠনের কর্মীরা আক্রমণ করে।এই আন্দোলনটি, ‘কানাড়া ছালুভালি ভেতাল’ দলের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ভটান নাগরাজ। তাদের দাবি ছিল জয়ললিতা যেন ক্ষমা চায়। কিন্তু জয়ললিতা সেটা করেননি। পরে তারা সিনেমার শুটিং বন্ধের দাবি জানায় এবং তাকে কানাড়া থেকে চলে যেতে বলেন। এলাকায় তার নামে পোস্টারিংও করা হয়। এই ভাবে তিনি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েন।আস্তে আস্তে তিনি তামিল, কন্নড় এবং তেলেগু সিনেমাতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বেশ কিছু খ্যাতনামা চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করে নেন। ১৯৭৩ সালে তার ‘সুরায়াগান্ধি’ চরিত্র সকলের মন জয় করে নিয়েছিল। এই সময় তার সাথে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন আর মুথুরামান। তিনি শুধু একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী নন বরং ভালো উপার্জনক্ষম নারীতে পরিণত হয়েছিলেন। পরিবারের পাশাপাশি তার স্বামীর পরিবারেরও খরচ যোগান দিতেন তিনি। কারণ তার স্বামী তারচেয়ে কম উপার্জন করতেন।তিনি প্রমাণ করেছিলেন, নারীদের কাজ শুধু রান্নাঘরের চুলা জ্বালানো নয়। তিনি নারী জাগরণের জন্য অনেক সিনেমা করেছেন। এর মধ্যে ১৯৭০ সালে সুপারস্টার শিবাজির সাথে এনগিরুন্ধো ভান্ধাল সিনেমাটি সবচেয়ে সারা জাগিয়েছিল। এছাড়া তিনি কমেডি সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন। গালাট্টা কালাইয়ানাম তার একটি কমেডি সিনেমা। এখানেও শিবাজি গানেশান তার বিপরীতে কাজ করেছিলেন। শিবাজি আর জয়ললিতা জুটি বেশ কিছু ধামাকাদার সিনেমা উপহার দিয়েছিল। এর মধ্যে সাভালে সামালি (১৯৭১), দেইভা মাগান (১৯৬৯), সুমাথি এন সুন্দারি (১৯৭১) উল্লেখযোগ্য।
বি.আর. পান্থালুর আইরাথিল অরুভান (১৯৬৫) জয়ললিতাকে সুপারস্টার বানিয়ে দিয়েছিল। সিনেমাটির নায়ক এম জি আর প্রথমে জয়ললিতার সঙ্গে কাজ করতে রাজি ছিলেন না। কারণ তিনি ওই সময় অনেক ছোট ছিলেন। তার সাথে জয়ললিতাকে মানাবে না এমনটা ভেবেই না করেছিলেন। কারণ তাদের বয়সের অনেক ফারাক যেটা মানানসই মনে হচ্ছিল না তার। কিন্তু নির্মাতার কথায় তিনি রাজি হয়ে যান আর এই সিনেমাটি পুরো তামিল মুভি ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে হিট সিনেমার একটি। এরপর এম. আর. জে এবং জয়ললিতা আরও ২৮টি সিনেমা করেন। যেগুলো ‘এভারগ্রীন’ সিনেমা হিসেবে খ্যাত। এর মধ্যে, নাম নারু (১৯৬৯), রামান থেডিয়া সিথাই (১৯৭২), এন আন্নান (১৯৭০) অন্যতম। পরবর্তীতে শোনা যায় এমজিআর জয়ললিতাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। জয়ললিতা ১৯৮২ সালে ‘এআইএডিএমকে’ তে যোগ দান করেন এবং ধীরে ধীরে সিনেমা জগত ছেড়ে রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হন এবং সেখানেও ভীষণ আলোচিত হয়ে ওঠেন।