ক্রাইমবার্তা রিপোট:বিশ্বের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি পড়ানো হয়, বাংলাদেশে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
বিশ্বের অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হলেও দেশের মধ্যে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি পড়ানো হয়। এ ছাড়া পাঁচটি উপাদানের মধ্যে চারটি বিদ্যমান থাকলেও বাংলাদেশের ভয়াবহ গণহত্যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বা জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায়নি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের গণহত্যা একদিকে যেমন বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে স্থান পাচ্ছে, অন্যদিকে একাধিক বিদেশি গবেষকও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। কিন্তু নিজ দেশের উচ্চশিক্ষায় বিষয়টি যেমন গুরুত্ব পায়নি, তেমনি এত বড় ঘটনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মেলেনি।
কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অ্যাডাম জোনস বলেছেন, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হলেও তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি আজও; বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার যুদ্ধ হিসেবে দেখার তীব্র প্রবণতা রয়েছে। তাঁর মতে, একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের শহীদ হওয়া এবং আড়াই লাখ নারীর সম্ভ্রমহানির ঘটনাকে খাটো করে দেখার চেষ্টা চলেছে।
২০১৪ সালে, মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পরে, ঢাকায় এ কথাগুলো বলেছিলেন অ্যাডাম জোনস। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসে ‘দ্য বাংলাদেশ জেনোসাইড ইন কমপারেটিভ পারস্পেকটিভ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে তিনি এ কথাগুলো বলেছিলেন। বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি এখন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিরই অন্তর্ভুক্ত।
তবে সংজ্ঞাগত ও তাত্ত্বিকভাবেই বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার কোনো কারণ নেই বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইডে গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ আছে। কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া—এই পাঁচটি উপাদানের কোনো একটি থাকলেই কোনো ঘটনা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তুরিন আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, শেষটি ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আর সব ধরনের অপরাধই সংঘটিত হয়েছে। তাই একে গণহত্যা না বলার কোনো কারণ নেই।
তবে এসব বৈশিষ্ট্য থাকার পর বাংলাদেশের গণহত্যা স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনীহাকে দায়ী করেন আর্জেন্টিনার আইনজীবী এবং সে দেশের গণহত্যার বিচারের আন্দোলনের কর্মী ইরেন ভিক্টোরিয়া মাসামিনো। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আমন্ত্রণে তিনি এখন বাংলাদেশে। গত সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিজেদের কোনো স্বার্থ না থাকলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গণহত্যা বা এর বিচারে দেশীয় ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে আগ্রহ দেখায় না। আর্জেন্টিনা ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একই বিষয় দেখা গেছে।’ ইরেন বলেন, বাংলাদেশ দেশীয় ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধীদের বিচারের যে কাজ শুরু করেছে, তা অনন্য। বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি আর্জেন্টিনায় পড়ানো হয়। বিষয়টি নিয়ে তাঁর দেশে যথেষ্ট আলোচনা রয়েছে।
কানাডা ও আর্জেন্টিনা ছাড়াও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত নির্মম গণহত্যার বিষয়টি ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো ও গবেষণা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি ও ডিপল ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ম্যাকোরি, ইউনিভার্সিটি অব হংকং ও পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লজে গণহত্যার বিষয়টি পড়ানো হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্টাডিজ প্রোগ্রামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইন্দোনেশিয়াসহ মোট ১৪টি গণহত্যার বিষয়ে উল্লেখ আছে। এর মধ্যে ‘আদার’ বা অন্য গণহত্যার তালিকায় বাংলাদেশের নাম আছে। বলা হয়েছে, এ গণহত্যার বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে।
বাংলাদেশের গণহত্যাকে ইয়েলের পাঠ্যসূচিতে স্থান দিতে ভূমিকা রেখেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক বেন কিয়েরনান। শাহরিয়ার কবির পরিচালিত তথ্যচিত্র ওয়ার ক্রাইম ১৯৭১-এ তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ২০ শতকের শেষ দিকে বাংলাদেশের গণহত্যা ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৬৫ সালে এবং পূর্ব তিমুরে ১৯৭৫ সালে সংঘটিত গণহত্যার মতোই ভয়াবহ।
অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ম্যাকোরির স্কুল অব লতে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন একাধিক গবেষক। হংকংয়ের ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুজানা লিন্টন ‘কমপ্লিটিং দ্য সার্কেল: অ্যাকাউন্টেবিলিটি ফর দ্য ক্রাইমস অব দ্য ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন’ শিরোনামে একটি গবেষণা করেছেন। ওই গবেষণাপত্রে তিনি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘দীর্ঘ ৩৭ বছর পর বাংলাদেশে একটি ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই প্রক্রিয়ায় নিজেদের শামিল করা।’
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক মাহমুদ শেরিফ বাসুয়ানি ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটিজ: হিস্টোরিক্যাল ইভল্যুশন অ্যান্ড কনটেম্পরারি অ্যাপ্লিকেশন শিরোনামে একটি গবেষণানির্ভর বই লিখেছেন। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এ বইয়ে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন।
পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লজের শিক্ষক টমাস লাওস্কি সম্প্রতি ২০১২ সালে ‘ট্রানজিশনাল জাস্টিস অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট অন সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টারনাল স্ট্যাবিলিটি ইন সাউথ-ইস্ট এশিয়া: দ্য কেস অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করেছেন। এর মূল বিষয়ও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে চর্চার বিশ্বজনীন তাৎপর্য কী? এ প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের চেয়ারম্যান আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও তাদের দোসরদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এই গণহত্যার বৈশ্বিক স্বীকৃতি দরকার। তিনি বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম গণহত্যার মতো একটি ভয়াবহ ঘটনার মধ্য দিয়ে। এই জন্মের ইতিহাস প্রজন্মান্তরে সক্রিয় রাখা দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের বাইরে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণহত্যা বিষয়টি পড়ানো হয় না বলে জানান দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সেন্টার ফর স্টাডি অন জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিস রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সূত্র জানায়, সেখানে সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিসের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাডাম জোনস, কম্বোডিয়ার হেলেন জারভিস, আর্জেন্টিনার ড্যানিয়েল ফিয়েরস্টেইনের মতো গণহত্যা বিষয়ে খ্যাতিমান গবেষকেরা।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মফিদুল হক প্রথম অলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিসরে বেশি করে আলোচনায় এসেছে। এর পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটি পাঠ্যবিষয় হিসেবে স্থান পেতে শুরু করেছে। তিনি জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলার সময় যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে এবং হাওয়াইয়ের ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টারের প্রতিনিধিরা যৌথভাবে আমাদের বিচার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে থাকেন।
আগামী বছরের এপ্রিল মাসে ঢাকায় ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টিকে সংস্থার সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সম্মতির জন্য উত্থাপনের চেষ্টা চলছে বলে জানান শাহরিয়ার কবির। এ নিয়ে আইপিইউর সভাপতি সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে কথা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোনো জনগোষ্ঠীর আন্তরিক তৎপরতা থাকলে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় যে সম্ভব, তার প্রমাণ আর্মেনীয়রা। ১৯১৫ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিকে তুরস্কে ১৫ লাখ আর্মেনীয় গণহত্যার শিকার হয়। গত শতাব্দীর প্রথম গণহত্যা বলে এটি স্বীকৃত। এই গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য আর্মেনীয়রা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেছে। বছর বিশেক আগে থেকে ওই হত্যাকাণ্ড গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। এ পর্যন্ত ফ্রান্স, রাশিয়াসহ ২০টি দেশ ওই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ বছরের জুন মাসে তুরস্কের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও জার্মানির পার্লামেন্ট আর্মেনিয়ার গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবিরও মনে করেন, বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়ে বৈশ্বিক স্বীকৃতির জন্য সরকারকে তৎপর হতে হবে এবং আর্মেনীয়দের মতো সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বে যখন বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয় আলোচিত হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যা দিবস আমাদের দেশে মোটেই পালিত হলো না। এ নিয়ে সরকারের মধ্যে তৎপরতার অভাব আছে।’
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই, এটা সত্য। আমরা দুই বছর আগে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা শুরু করেছিলাম। মাঝপথে তা থেমে গেলেও আবার আমরা সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’