বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, আপনাকে স্যালুট!

ক্রাইমবার্তা রিপোট:ডেটলাইন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ অপারেশনে থাকা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্যতম লেফটেন্যান্ট জেনারেল জ্যাকব ফার্জ রাফায়েল ‘জেএফআর’ জ্যাকবের হাতঘড়িতে তখন বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিট, যা বাংলাদেশ সময়ানুসারে ৫টা ২৫ মিনিট। সেদিন এ সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি সদলবলে তদানীন্তন ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেন।34

সেই বিজয়ের পয়তাল্লিশতম বার্ষিকীতে তারই ইতিবৃত্তটি অনলাইনে পড়ছিলাম ঢাকার ডেটলাইনে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত অঞ্জন রায়ের নিবন্ধ :‘পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিলেন জ্যাকব’। এতে যেখানটায় দৃষ্টি স্থির হয়েছে, সেখানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের অভ্যন্তরে গড়া কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর কথা রয়েছে। তখন কানাডায় ১৫ ডিসেম্বর মধ্যরাত পেরোতে আধা ঘন্টা বাকি। কাকতালীয়ভাবে এই বঙ্গবীরকে নিয়ে নির্মিত ও প্রখ্যাত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন অভিনীত ‘বাঘা বাঙ্গালী’ ছায়াছবির কথাটিও মনে পড়লো। ওই চলচ্চিত্রের সমাপনী দৃশ্যে প্রদর্শিত টাঙ্গাইল জেলা সদরের ‘শামছুল হক তোরণ’ মুখে স্বাধীনতার পতাকাবাহী এক ঝাক উন্মত্ত তরুণের মাঝে আমার মামা সৈয়দ মাহমুদুল ইলা মাসুদ বিমূর্ত। এখন তিনি টরন্টোয়; সেই সুযোগে ফোনে জানালাম- মামা, আজ বিজয় দিবসে বঙ্গবীরকে ফোনে স্যালুট জানাতে চাই। তাতে কনফারেন্সে থাকার সম্মতি প্রকাশ করতেই বঙ্গবীরকে কল দেই। ফোন ধরতেই তাকে স্যালুট জানিয়ে কুশলাদি বিনিময় হলো এবং এক অভূতপূর্ব অনুভূতিতে জানলাম- তিনি ভালো আছেন!

যে নিবন্ধটি পড়ছিলাম, সেটি মেজর জেনারেল জে আর এফ জ্যাকবের ‘সারেন্ডার এট ঢাকা’ গ্রন্থ অবলম্বনে রচিত। তাতে বর্ণিত রয়েছে- ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দিনে ভারতের মাত্র তিন হাজার সৈন্য ছিল ঢাকার আশপাশে। অন্যদিকে, ঢাকাতেই পাকিস্তানের সৈন্য ছিল ২৬ হাজারের বেশি। বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে পিছু হটা অনেক পাকিস্তানি সৈন্যও ছিল ঢাকার পথে। কিন্তু, ভারত বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর দায়িত্বে থাকা জেনারেল স্যাম মানেকশ জ্যাকবকে বলেছেন, ‘যাও এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য করো’। বাস্তবে সেটা ছিল এক দুঃসাহসী অভিযান। ৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ২৬ হাজার সৈন্যকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়।

১৫ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ভারতীয় বাহিনীর ১০১ কমিউনিকেশন জোনের অধীন ৯৫ এবং ১৬৭ মাউন্টেন ব্রিগেড দু’টি যথাক্রমে ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিংয়ের নেতৃত্বে দ্রুততার সঙ্গে জামালপুর-ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল-মির্জাপুর-জয়দেবপুর-টঙ্গি অ্যাক্সিস ধরে উত্তর দিক থেকে ঢাকার দিকে এগিয়ে যায়। ১৬৭ মাউন্টেন ব্রিগেডের একটি দলের সঙ্গে সাভার এলাকায় ১০১ কমিউনিকেশন জোনের জিওসি জেনারেল নাগরা এসে যোগ দেন। ১৬ ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে মিরপুর সেতু হয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করে জেনারেল নাগরা পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের জন্য অনুরোধ করেন।

‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ গ্রন্থে জ্যাকব লিখেছেন, ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার দিকে জেনারেল মানেকশ ফোন করে ঢাকা উড়ে যেতে এবং ওই বিকেলেই আত্মসমর্পণের আয়োজন করতে বলেন। তিনি হেলিকপ্টারে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তাকে স্বাগত জানান পাকিস্তানের ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী। কয়েক জন বিদেশি সাংবাদিকও উপস্থিত ছিলেন।

সেখান থেকে তাঁরা গাড়িতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়াজির সদর দফতরে চলে যান। পথে মুক্তিবাহিনীর সদস্যেরা গাড়ি থামান। ‘যুদ্ধ শেষ এবং বিকেলে রেসকোর্সে আত্মসমর্পণ করবে পাকিস্তানি বাহিনী’ এ কথা জানিয়ে তিনি ছুটে যান পূর্বাঞ্চলে সবচেয়ে বড় দুর্গ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে পৌঁছনোর পর তাদের স্বাগত জানান নিয়াজি।

ইতিহাসের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! আত্মসমর্পণের আয়োজন করতে আলোচনায় বসছেন পাকিস্তানের ‘দুধর্ষ সেনাবাহিনীর সেনাপতিরা’! নিয়াজির সঙ্গে ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি, মেজর জেনারেল জামশেদ, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফসহ আরও কয়েক জন। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের নেতৃত্বই চাইছিলেন আত্মসমর্পণ হোক প্রকাশ্যে। যে ঢাকার জনগণ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও তাদের দালালদের হাতে এত নির্যাতিত হয়েছে, তাদের এ আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে হাজির থাকার সুযোগ দিতেই হবে।

ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে জ্যাকব নিয়াজিকে নিয়ে ফের ঢাকা বিমানবন্দরে যান। আবারও মুক্তিবাহিনীর বাধা। অনেক কষ্টে এ বাধা অতিক্রম করে তারা বিমানবন্দরে পৌঁছান। কিন্তু সেখানেও তখন পর্যন্ত কোনো ভারতীয় সেনা ইউনিট পৌঁছতে পারেনি। তবে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে একটি ট্রাক রানওয়ের কাছে পৌঁছে যায়। এই ট্রাকেই ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। মুক্তিবাহিনীর সদস্যেরা নিয়াজির উপর হামলা চালাতে পারে, এমন ভয় করছিলেন জ্যাকব। তবে তেমন কিছু ঘটেনি।

বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে অরোরা এবং তাঁর স্ত্রী ঢাকায় অবতরণ করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের এ কে খন্দকার। তারা দ্রুত চলে যান রেসকোর্স ময়দানে, যেখানে ৭ মার্চ লাখ লাখ জনতার সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। আত্মসমর্পণের উপযুক্ত জায়গাই যে বাছাই করা হয়েছিল! গার্ড অব পরিদর্শন শেষে অরোরা ও নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে সই করার জন্য নির্ধারিত টেবিলের পাশে থাকা দু’টি চেয়ারে বসেন। নিয়াজি তার পয়েন্ট ৩৮ রিভলভার যখন হস্তান্তর করেন, তাঁর চোখ ভিজে যায়।

ভারত জানিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে দু’হাজার ৩০৭ জন সৈন্য প্রাণ দিয়েছেন। আহতের সংখ্যা ৬ হাজার ১৬৩ জন। আর নিখোঁজ ছিলেন দু’হাজার ১৬৩ জন। নিখোঁজরা নিহত বলেই ধরে নেওয়া যায়। পূর্ব রণাঙ্গনে তাদের মৃতের সংখ্যা পশ্চিম রণাঙ্গনের তুলনায় কম। বাংলাদেশের মুক্তির অভিযানে তাদের সশস্ত্র বাহিনীর এক হাজার ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর পশ্চিম রণাঙ্গনে নিহত হয়েছেন এক হাজার ২০৬ জন।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ৩০ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু আত্মদান করে। আরও অনেকে নানা ভাবে নির্যাতিত হন। ধর্ষিত হন প্রচুর নারী। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা।

পাদটীকা: তবে ‘সারেন্ডার এট ঢাকা’ গ্রন্থে বলা হয়নি মেজর জেনারেল নাগরার নেতৃত্বাধীন নিয়াজির আত্মসমর্পণের পুরো প্রস্তুতিতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন একত্রে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিং ওরফে ‘বাবাজি’। এতে পাকিস্তানী বাহিনীর মেজর জেনারেল জামশেদই প্রথম তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সে কথা স্বয়ং বঙ্গবীর জানিয়েছেন। তাতে উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছে- স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও জামালপুর নিয়ে গঠিত এগার নম্বর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তদানীন্তন মেজর জিয়াউর রহমান ওই অঞ্চলের কামালপুর ও বাহাদুরাবাদে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে আগেই চরমভাবে বিপর্যস্ত করেন। পরবর্তীতে সেটাই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে কৌশলগতভাবে মেজর জেনারেল জি এস নাগরা’র নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঢাকা আগমনের ‘অ্যাক্সিস’ বা পথকে ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর উন্মুক্ত করে দেয়। এক্ষেত্রে বঙ্গবীরের নেতৃত্বাধীন ৭ হাজার ‘কাদেরিয়া বাহিনী’র ভূমিকাটি ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সেই স্বগতোক্তি রয়েছে মেজর জেনারেল ডি কে পালিতের ‘দ্য লাইটেনিং ক্যাম্পেইন: ইন্ডো-পাকিস্তান ওয়ার, ১৯৭১’ গ্রন্থে।

Check Also

প্রত্যেকটা অফিসের কেরানি পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের দোসর : আসিফ মাহমুদ

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।